আপডেট : ৫ অক্টোবর, ২০২৩ ০৮:১২
হস্তশিল্পে স্বাবলম্বী মনজুরুল
মীর আনোয়ার আলী, রংপুর

হস্তশিল্পে স্বাবলম্বী মনজুরুল

আত্মবিশ্বাস, চেষ্টা, ধৈর্য, শ্রম ও সঠিক লক্ষ্য থাকলেই মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘোরে, তার জলন্ত উদাহরণ মনজুরুল ইসলাম।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বালাচওড়া গ্রামে নিম্ন মধ্যবর্তী পরিবারে তার জন্ম। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। অভাবের সংসারে বাবার অকাল মৃত্যুতে থেমে থাকেনি আজকের সেই ২৬ বছরের যুবক। চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পরিবারের অভাব দূর করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে প্রতিষ্ঠিত করার। তবে পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কী করবেন। পরিবারের অভাব ও পেটের ক্ষুধা নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যান রংপুর থেকে দিনাজপুর শহরে, খুঁজে নেন পাটকলের শ্রমিক হিসেবে একটি চাকরি। সেখানে ৩ বছর কাজ করার পর টাকা জমিয়ে একটি ইজিবাইক কিনে ভাড়া দেন।

ভাড়ায়চালিত ইজি বাইকটি চুরি হয়ে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায় মনজুরুল ইসলামের। হতাশাকে সঙ্গী করে আবার ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। কিন্তু নিজের মনোবলকে ভাঙতে দেননি এতটুকু।

২০১৬ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক তরুণীকে বিয়ে করে দেখেন ঘর বাধার স্বপ্ন। শাশুড়ি মনসুরা বেগম শুধু একজন গৃহিণী ছিলেন না, তিনি নিজেই পাট দিয়ে হস্তশিল্পের নানা জিনিস তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মনজুরুল ইসলাম তার শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে তার হস্তশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একমত হন এবং ধীরে ধীরে তিনি নিজে শেখেন হস্তশিল্পের কাজ। কাজের অবসরে বাইসাইকেল চালিয়ে দোকানে দোকানে বিপণনের চেষ্টা করেন।

পাটশিল্পের তৈরি পাপোশ, স্কুল ব্যাগ, শতরঞ্জি, ডাইনিং ম্যাট, ফুলদানি, ঝুড়ি, সেই প্রাচীনকালের ঐতিহাসিক শিকা, কৃত্রিম ফুলের গাছ রাখার টপ, সুন্দর সুন্দর ওয়ালমেট ইত্যাদি বাজারে বিক্রি করে গ্রাহক তৈরি করেন এবং পাশাপাশি তার ব্যবসা প্রসিদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

পুরুষ ও নারীদের বাসায় ডেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের মাসিক বেতন দিয়ে পরিবারগুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলেন।

২০১৮ সালে চালু করেন মনছুরা জুট হ্যান্ডিক্রাফটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অজপাড়াগাঁয়ে প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত হলেও প্রায় ২০ থেকে ২৫টি গ্রামের অসহায় পুরুষ ও নারীরা পাটপণ্য তৈরি করার কারখানায় বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত।

গতকাল বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন কর্মচারী তার কারখানায় কাজ করছেন।

কথা হয়, সুইং অপারেটর রবি বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা এটে কাজ করি ভালোই দিন কাটাওছি। এখন মোর বেতন নয় হাজার টাকা, আর কি নাগে। ঘরত অসুস্থ স্বামী, চিকিৎসার খরচপাতি, ছইল গুলার লেখাপড়ার খরচ দেও, মুই ভালোই আছো।’

কথা হয়, মাসুদ রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মনজুরুল ভাইয়ের কারখানায় কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পাই। এখন সচ্ছলতার কারণে পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে। মনজুরুল ভাইয়ের কারখানায় শ্রমিকরা মাসিক ৭ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন। মনজুরুল ভাইয়ের বুদ্ধি, সততা, মেধা ও সৎ প্রচেষ্টা তাকে অনেক উপরে নিয়ে গেছে।’

গোপালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, ‘মনজুরুল এই কারখানা দিয়ে শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হননি, এলাকার অনেক অসহায় নারী ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই ধরনের পাটশিল্পের হস্ত কারখানা এখানে সৃষ্টি হওয়ায় এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। সেইসঙ্গে পাটশিল্পের মাধ্যমে কারুপণ্য তৈরি হওয়ায় পাটচাষিকে পাট চাষে উৎসাহিত করছেন তিনি।’

মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘সংসারে অভাব, আর বেকার মানুষের কষ্ট আমি বুঝি। এক দিন আমিও অভাবের তাড়নায় পেটের ক্ষুধা নিয়ে কৈশোরে ঘর ছাড়ি। কিন্তু শত কষ্টের মধ্যেও আমার মনোবল কখনো ভাঙেনি। আজ অর্থনৈতিকভাবে নিজেও স্বাবলম্বী হয়েছি, এলাকার নারী-পুরুষেরও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে পেরেছি। এটাই আমার আত্মতৃপ্তি।’