আপডেট : ৬ অক্টোবর, ২০২৩ ১৩:১৩
রেলগাড়ির ইতিবৃত্ত
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

রেলগাড়ির ইতিবৃত্ত

১৯৮৪ সালের কথা। তখন আমি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করি। সে সময় আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ইয়র্কশায়ারে রাখা প্রথম রেলওয়ে বাস্পীয় ইঞ্জিন। বস্তুত রেল ইঞ্জিনের আবিষ্কারক ছিলেন জর্জ স্টিভেনসন। আর বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কারক জেমসওয়ার্ট। এদিকে বিশ্বে প্রথম আন্তনগর রেলওয়ে লিভারপুল টু ম্যানচেস্টার (১৮৩০) সেই রেলওয়েতে একবার বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। এদিকে এই রেলওয়ে সংক্রান্ত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপকথা, ইত্যাদি সাহিত্য অঙ্গনে যত জায়গা জুড়ে আছে। অন্য কোনো পরিবহন তেমনটা নয়। যাক ওসব কথা। এবার আসুন রেলওয়ে নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলাপ-আলোচনা করা যাক।

আসলে রেল পরিবহনের ধ্যান-ধারণা ও কার্যক্রম যিশুখ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে গ্রিসে শুরু হয়। এ সূত্র ধরে সেখানে ৬ কিলোমিটার থেকে সাড়ে ৮ কিলোমিটার রেলপথের প্রমাণ মেলে। অবশ্য সেখানে মানব ও পশুচালিত চাকাযুক্ত রেলযান ব্যবহার করা হতো। আর রেলপথে চুনাপাথরের খাঁজ ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীকালে রোমান কর্তৃক শাসিত মিসরে এর ব্যবহারের কথা শোনা যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, রেলপথ বলতে সমান্তরালভাবে পাতা ইস্পাতের মোটাপাত দিয়ে তৈরি পথের (রেল) ওপর দিয়ে বিশেষ ধাতব চাকাযুক্ত গাড়ি (রেলগাড়ি) চালনার মাধ্যমে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনের ডিভাইস বা উপায়কে বোঝায়। আর সড়ক পরিবহনে যানবাহনগুলো প্রস্তুতকৃত সমতল পৃষ্ঠতলের ওপরে চলাচল করে। এদিকে রেলগাড়িগুলি যে রেলপথের ওপর দিয়ে চলে। সেই রেলপথ দ্বারা নির্দিষ্ট দিকে চলাচল করে। উল্লেখ্য, রেলপথে ইস্পাতের তৈরি সমান্তরাল রেলগুলোকে ধরে রাখার জন্য কাঠের বাঁধুনি বা স্লিপার ব্যবহার করা হয়, আর এগুলো নুড়িপাথরের পরিস্তরণ (ব্যালাস্ট) দিয়ে তৈরি ভিত্তির ওপর স্থাপিত। তবে কিছু কিছু রেলপথে রেলগুলোকে কংক্রিটের ভিত্তির ওপরেও বসানো হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য যে, রেল পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রেলযানগুলো সাধারণত সড়কযান অপেক্ষা কম ঘর্ষণজনিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তাই যাত্রীবাহী রেলগাড়ি ও মালবাহী রেলগাড়িগুলোকে একটির পর একটি লাগিয়ে লম্বা রেলগাড়ি বা ট্রেন বানানো সম্ভব হয় এবং রেলগাড়িগুলোকে টানার জন্য বিশেষ ইঞ্জিনগাড়ি (লোকোমোটিভ) থাকে; যেগুলো সাধারণত ডিজেল নামক জ্বালানি তেল পুড়িয়ে অথবা বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা থেকে বিদ্যুৎশক্তি আহরণ করে শক্তির চাহিদা পূরণ করে। অবশ্য অতীতে এ ক্ষেত্রে পাথুরে কয়লা ব্যবহার করা হতো। আর বেশির ভাগ রেলপথের সঙ্গে রেল সংকেত ব্যবস্থাও বিদ্যমান থাকে। পরিবহনের অন্যান্য প্রপঞ্চের তুলনায় রেল পরিবহন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।

সময়ের পরিক্রমায় দিনের ওপর দিন ভর করে এগিয়ে যেতে থাকে। এ সূত্র ধরে ১৮৮০ সালের দিকে বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ির উদ্ভাবন হয়। ফলে দ্রুতগামী জনপরিবহন ব্যবস্থা ও ট্রামগাড়িগুলোর বিদ্যুতায়ন ঘটে। ১৯৪০ সালের শুরুর দিকে বাষ্পচালিত রেলগাড়ির পরিবর্তে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনগাড়ি ব্যবহার শুরু হয় এবং এরই সুবাদে ১৯৬০ সালে জাপানে বিদ্যুতায়িত উচ্চগতির রেল ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। বর্তমানে জাপান ছাড়াও চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলো ইত্যাদিতে উচ্চগতিসম্পন্ন রেল ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। বর্তমানে অনেক দেশই পরিবেশগত কারণে তাদের ডিজেলচালিত ইঞ্জিন থেকে সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনে রূপান্তর করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী রেলগাড়ি ছাড়াও মনোরেল (একটিমাত্র রেললাইন) ও ম্যাগলেভ (চৌম্বকীয় উত্তোলন) ধরনের রেল ব্যবস্থা সীমিত আকারে হলেও কিছু কিছু দেশে চালু হয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মোটরগাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে রেল পরিবহনে ভাটা পড়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সড়কপথে যানজট ও জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে রেল পরিবহন আবারও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এতদ্ব্যতীত নানা দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে সেই মতে রেল ব্যবস্থাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা শুরু করেছে, যা পরিবেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

বাংলাদেশ রেলওয়েকে মূলত দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। একটি অংশ যমুনা নদীর পূর্ব পাশে এবং অপরটি পশ্চিম পাশে। এদেরকে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। পূর্ব পাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১২৭৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিম পাশের অংশের দৈর্ঘ্য ১৪২৭ কিলোমিটার। এতদ্ব্যতীত দক্ষিণাঞ্চলের রূপসা নদীর পূর্ব প্রান্তের ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রূপসা-বাগেরহাট ব্রডগেজ রেলপথ সেকশনটিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের তৃতীয় অংশ হিসেবেও ধরা হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের রেলপথ চালু আছে: ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি বা ১,৬৭৬ মি.মি.) এবং মিটার গেজ (১০০০ মি.মি.)। দেশের পূর্বাঞ্চলে মিটার ও ব্রডগেজ উভয় ধরনের রেলপথ বিদ্যমান। অবশ্য পূর্বাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বে রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথও রয়েছে। আগে ন্যারোগেজ (২ ফুট ৬ ইঞ্চি বা ৭৪৬ মি.মি.) রেলপথ চালু থাকলেও এখন আর তা ব্যবহার হয় না।

পরিশেষে বলতে চাই যে, এ বিশ্বের ছোট-বড় মিলে ২৩০টি দেশের মধ্যে অধিকাংশ দেশে রেললাইন চালু আছে। আর ক্রমঅগ্রসরমান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেল ব্যবস্থাও এগিয়ে চলেছে। এদিকে আদর্শ পরিবহন ব্যবস্থায় যতগুলো নিয়ামক থাকা আবশ্যক, তার প্রায়গুলো এতে বিদ্যমান।

লেখক : গবেষক