আপডেট : ১৫ অক্টোবর, ২০২২ ১৩:০৮
ইকো সিস্টেম রক্ষা করাই সবচেয়ে জরুরি

ইকো সিস্টেম রক্ষা করাই সবচেয়ে জরুরি

ছবি: সংগৃহীত

মো. আশরাফ-উদ-দৌলা

জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বলছে, অনাদিকাল থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি এই গ্রহে এক বিলিয়নের বেশি মানুষ ছিল না। তবে ১৮৫০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০০ বছরে এই জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মাত্র ৭২ বছর পর এ গ্রহে এখন মানুষের সংখ্যা ৭ দশমিক ৯ বিলিয়নের বেশি। বেশি মানুষেরই অর্থ হলো জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য অনেক বেশি উপকরণের ব্যবহার, অনেক বেশি সম্পদের ব্যবহার। মানুষের সেসব চাহিদা মেটানোর জন্য বিজ্ঞানও নিয়ে আসছে নব নব উদ্ভাবন।

শারীরিকভাবে অনেক প্রাণীর তুলনায় অত্যন্ত দুর্বল হয়েও শুধু জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছে সৃষ্টি জগতের সেরা। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের মুনাফার তাড়নায় চলা থেকে সৃষ্ট নব আবিষ্কার হয়ে উঠছে সীমাহীন ভোগবাদের উপকরণ। এই অনাসৃষ্টির পরিবর্তনের দুর্বিপাকে বর্তমান পৃথিবীর সীমিত সম্পদ জটিলতার আবর্তে ঘূর্ণিরত আছে। যাতে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে বিশ্বের এতদিনকার গড়ে ওঠা ইকো সিস্টেম।

২০০ বছর আগে মানুষের এই আত্মবিনাশী পথে চলার শুরু হয় আঠারো শতকের গোড়ার দিকে এডাম স্মিথ সমাজের মানুষকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির এমন এক পথরেখা দেখিয়ে দিলেন, যাতে মানুষ সেই পথকে আত্মস্থ করে ব্যক্তিগত জীবনে অধিক উন্নতি করতে পারে। তার এই অর্থনৈতিক দর্শনের মূল প্রতিপাদ্যই ছিল অধিক উৎপাদনের সমৃদ্ধি। এ দর্শন ভীষণভাবে আলোড়ন তুলল দুনিয়ায়। কলকারখানার প্রসারণ ঘটল আর শিল্প পুঁজিবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ধরনও পাল্টে গেল। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা কয়েকজনে সীমাবদ্ধ থাকায় সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি হলো। এর সবচাইতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ল তখন পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সমাজে।

বর্তমান দুনিয়ায় আজ এই পুঁজির বল্গাহীন পরিক্রমা অনেক সংকট তৈরি করছে। এর মূলে রয়েছে পুঁজিবাদের ব্যক্তিমালিকানার ধারণা থেকে সৃষ্ট স্বার্থপরতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। পুঁজির দাপট যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশ বিপন্ন আগ্রাসী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তেমনি মানুষ হয়ে উঠেছে চরম আত্মকেন্দ্রিক। দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের মতো মহৎ গুণাবলির জলাঞ্জলি ঘটিয়ে মানুষ আজ স্বার্থপরতা আর আত্মসেবার মন্ত্রে ছুটছে। জনগণের প্রজাতন্ত্র আজ শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার কেতাবেই সীমাবদ্ধ থাকছে। এটি নিয়ে সমাজের সমাজপতি আর বিজ্ঞজনরা বিচলিত হলেই করার থাকছে না কিছু। প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, আগামী প্রজন্মকে কি এই নেতিবাচক আত্মোন্নয়নে সৃষ্ট বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারব?

আমাদের দেশেও যারা দেশের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন বা যারা দেশকে ভালোবেসে কবিতা লিখেছিলেন কিংবা রং-তুলিতে এক সমৃদ্ধ জন্মভূমির ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন, তারা আজ হতাশ। মুষ্টিমেয়র সমৃদ্ধি বৈষম্যে ফেলে দিয়েছে অগণিতকে। সীমাহীন নগরায়ণ কেড়ে নিচ্ছে প্রশান্তিময় ভূমিকাঠামো। শান্তির পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে বৈশ্বিক যুদ্ধের দামামায়। নিজের দেশের এই অস্থিরতা বৈশ্বিক সংযোগে যুক্ত হয়ে প্রশ্ন তুলছে- আমরা কি সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থার কাঠামোকে উল্টো রথে চালাচ্ছি?

আত্মকেন্দ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের মাঝে সীমাহীন লোভ তৈরি করছে। সমন্বয়হীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতায় ভারী হয়ে উঠছে সামাজিক পরিবেশ।

প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে খুব কঠিন আলোচনা প্রয়োজন নেই। বস্তুত উন্নয়ন আর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রসারিত লোভের প্রকাশ আমাদের সমাজব্যবস্থায় দিনে দিনে যে সমন্বয়হীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার বীজ বপন করেছিল আজকের এই সমাজিক পরিবেশ তারই বহিঃপ্রকাশ। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে এর কিছু সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। সামাজিক সুবৃত্তিগুলো হারিয়ে গিয়ে আত্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। মায়া-মমতা হারিয়ে মানুষ হয়ে উঠছে পাশবিক। সমাজ হয়ে উঠছে শৃঙ্খলার পরিপন্থি। আসলে এই বিচ্ছিন্ন আত্মগত উন্নয়ন সমাজকে আত্মবিনাশী পরিণতিতে নিয়ে যাচ্ছে। এর মূলে রয়েছে পুঁজির ফটকা গতিতে চলার উদ্দামতা। আর সেটাই মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে সীমাহীন ভোগবাদের কাছে।

এই অর্থব্যবস্থাই সামাজিক অবস্থানকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আর তাতেই দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্র। যেকোনো উপায়ে আত্মসমৃদ্ধিই হয়ে উঠছে মূল দর্শন। তাই অবৈধ অর্থায়নে সমৃদ্ধ হতে বিবেক বাধা দিচ্ছে না আর। সামাজিক নৈতিকতা তাই আজ হারিয়ে যাচ্ছে। বিচারহীনতা আর অব্যবস্থাপনাই মুখ্য হয়ে উঠছে।

কিন্তু এই কুপ্রবৃত্তিগুলোর সুফল পাচ্ছে গুটিকয়েক। অধিকাংশরাই থেকে যাচ্ছেন বঞ্চিত আর নিপীড়িত। বৈষম্য তাদের সেই দুর্বৃত্তায়নের পথে নিতে পারছে না। সমাজের শীর্ষে থাকারাই এই অনাচারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সে জন্য রাষ্ট্রের যেমন সংস্কার প্রয়োজন, তেমনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও পরিবর্তন জরুরি। সে জন্য আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যেমন বলে গিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারীদের ব্যক্তিগত সম্পদ না রাখার কথা, সেই পথকে অনুসরণ করা দরকার। তারা ‘জ্ঞান’ আর ‘প্রজ্ঞা’র জন্যই দেশের সম্পদ বিবেচিত হবেন। এটা এখনকার আত্মোন্নয়নের দর্শনে ধ্বংসের দিকে ধাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সম্পদের স্বচ্ছ বিবরণ থাকতে হবে এবং সেটা উন্মুক্ত থাকবে। তৃতীয়ত, দেশের যোগ্যদের দায়িত্বে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক মনিটরিং সেল থাকবে। চতুর্থত, ভোগবাদের হাত থেকে বাঁচতে জোরদার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি ইকো সিস্টেমকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষানবিশ গবেষক