আপডেট : ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ১১:১১
‘পুঁজিবাজারে ডিমান্ড তৈরির চ্যালেঞ্জ নিতে হবে’
সুলতান আহমেদ

‘পুঁজিবাজারে ডিমান্ড তৈরির চ্যালেঞ্জ নিতে হবে’

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন

মানুষ এখন বিনিয়োগের ভালো জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, যাদের কাছে বিনিয়োগ উপযোগী অর্থ রয়েছে তারা বাধ্য হয়ে ব্যাংকে যাচ্ছেন, তবে তারা পুঁজিবাজার এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। বিনিয়োগকারীদের কাছে পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আনা সম্ভব। তিনি মনে করেন, গেল কয়েক বছরে বাজারে যেভাবে সাপ্লাই বেড়েছে ওই তুলনায় ডিমান্ড বাড়েনি। তাই নীতিনির্ধারকদের বাজারে ডিমান্ড তৈরির চ্যালেঞ্জ নেয়ার পরামর্শ তার। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুলতান আহমেদ

পুঁজিবাজারে এখন লেনদেন খরা যাচ্ছে, সূচকও প্রায় একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এখান থেকে বাজার ভালো করার উপায় কী বলে মনে করেন?

: এটা সত্য যে, গত কয়েক মাস ধরে পুঁজিবাজার প্রায় একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দু-একদিন সূচক একটু বাড়ে তার পরই আবার পতন। আবার বড় পতনও হচ্ছে না, কারণ প্রতিটি শেয়ারে সর্বনিম্ন দরসীমা বা ফ্লোর প্রাইস দেয়া রয়েছে। এমন অবস্থা থেকে বাজারকে উদ্ধারে এখন সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো নতুন বিনিয়োগ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা বিনিয়োগ করবে? অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তাদের বাজার সম্পর্কে ইতিবাচক সংবাদ দিতে হবে। আস্বস্ত করতে হবে- এই বাজারে আসলে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকবে। তখন দেখা যাবে অনেকেই নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছে। বিনিয়োগ তো হয় একজনকে দেখে আরেকজনের। এখন নতুন কিছু ফান্ড বা বিনিয়োগ আনতে পারলেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালো হতো। কিছুদিন বাজার ভালো থাকলে বিনিয়োগ আসতে শুরু করত।

বাজারে ফান্ড আনার দায়িত্বটি কাদের নিতে হবে?

: সবার আগে আস্থা ফেরাতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে ফান্ড এমনিতেই আসবে। তবে এসবের জন্য আগে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে হবে। দেখুন গেল কয়েক বছরে কতগুলো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে? এর বিপরীতে বিনিয়োগ কতটুকু বেড়েছে? বাস্তবতা হলো কোম্পানি বেড়েছে, তবে বিনিয়োগ কমেছে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে যে পরিমাণ কোম্পানি লিস্টেট ছিল বর্তমানে তার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেড়েছে কোম্পানির সংখ্যা। অর্থাৎ সাপ্লাই ২০১০ সালের তুলনায় চারগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে ওই সময়ে বাজারে লেনদেন হতো আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা, বর্তমানে যা নেমে এসেছে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটিতে। অর্থাৎ লেনদেন কমে এসেছে সাত ভাগের এক ভাগে। একদিকে সাপ্লাই চারগুণ হলো অন্যদিকে ডিমান্ড সাত ভাগের এক ভাগে নেমে এলো, তাতে বাজারে কীভাবে গতি আসবে। এ জন্য বাজারে এখন ডিমান্ড বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সাপ্লাই যথেষ্ট হয়েছে এখন সময় এসেছে সাপ্লাই কমিয়ে ডিমান্ড বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়ার। কোন ধরনের বিনিয়োগকারী বাজারে আসতে ইচ্ছুক, কী করলে তারা বাজারে বিনিয়োগ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে কিংবা তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে কী করা যায়, তা নিয়ে এখন ভাবতে হবে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, সাধারণ মানুষ না বুঝেই বাজারে আসবে। মানুষের টাকা ঠিকই ফিনান্সিয়াল ট্রানজেকশন হচ্ছে, অর্থাৎ কেউ ব্যাংকে রাখছে, কেউ সঞ্চয়পত্র কিনছে এবং এসব জায়গায় তারা খুব ভালো কোনো লাভও পাচ্ছেন না। এ ধরনের মানুষের কাছে বিশ্বাস তৈরি করতে পারলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ অবশ্যই আসবে।

তাহলে বিনিয়োগ বাড়লেই বাজার ইতিবাচক হবে?

: বিনিয়োগ এলে প্রাথমিক কাজটা হয়ে যায়। এরপর আসে সুশাসনের প্রশ্ন, সেখানে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। যারাই বাজারে ফাউল প্লে করবে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক ম্যাসেজ যাবে। এগুলো হলে লেনদেন আপনা-আপনি বাড়বে। আবার যেমন লেনদেন না হওয়ার পেছনে বড় কারণ এখন ফ্লোর প্রাইস। আগে এক লাখ টাকা একজন বিনিয়োগকারী সপ্তাহে দুই বার কেনাকাটা করতে পারত। দেখা যেতে এক লাখ টাকার ‍মূলধনে তার লেনদেন হয়েছে তিন থেকে চার লাখ টাকা। তবে এখন হাজার হাজার কোটি টাকা আটকে আছে ফ্লোর প্রাইসে। যার কারণে স্বাভাবিক লেনদেনই হচ্ছে না। তাতে লেনদেন নেমে এসেছে চারশ থেকে পাঁচশ কোটিতে। রেগুলেটদের এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে। বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে থাকবে- এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মার্কেটকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। ফ্লোর থেকে বের হয়ে এলে হয়তো বাজারে কিছুদিন নেতিবাচক প্রবণতা থাকবে, তবে পরক্ষণে আবার ডিমান্ড অর্থাৎ বিনিয়োগ বেড়ে যাবে।

২০১০ সালের কথা বললেন আপনি, এত বছরেও কেন ডিমান্ড তৈরি করা যায়নি?

: দেখুন, বাজারে ভালো গ্রাহকরা আসবে ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনতে। ধরুন কেউ কোনো দোকানে গিয়ে চাইল ‘ঘি’, তাকে দেয়া হলো ‘ছাই’, তাতে ওই গ্রাহক কোনোদিনও আর ওই দোকানে যাবেন না। পুঁজিবাজারে অনেক ভালো গ্রাহক ছিল, যারা ভালো কোম্পানি ভেবে দুর্বল শেয়ার কিনে প্রতারিত হয়েছেন। তাদের আপনি এখন যা-ই বলেন তারা আসবেন না। এখন কথা হচ্ছে, কেউ যাবে কেউ আসবে এটাই বাজারের নিয়ম। নতুন করেও যে আনবেন সেখানেও নানা বিষয় কাজ করছে। কোনো কোনো কোম্পানি ১০০ থেকে হঠাৎ ৯০০ টাকা হয়ে গেছে, যেগুলো মোটেই ভালো কোম্পানি নয়। আবার যেগুলো ভালোমানের কোম্পানি সেগুলো দিনের পর দিন একই জায়গায় পড়ে আছে। তাই অনেক গ্রাহক এখানে ঘি খুঁজে পাচ্ছেন না। বাজারে ভালো মানের কোম্পানি এলে ভালো গ্রাহকও ওইসব শেয়ার কিনতে আসবেন।

সামনে নির্বাচন আসছে, এ সময়ে বাজার নিয়ে আপনি কী মনে করেন?

: দেখুন, নির্বাচন তো নতুন কিছু নয়। এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন হবে, নিয়ম অনুযায়ী পুঁজিবাজার চলবে। আমি মনে করি না, নির্বাচনের জন্য বাজারে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা কোনো ‘বাবল’ মার্কেট হলে হয়তো সম্ভাবনা ছিল। তবে বর্তমান বাজার তো এমনিতেই তলানিতে রয়েছে। এখান থেকে আরও নেতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না। করোনাকালে যখন পুরো বিশ্বে নেতিবাচক প্রবণতা ছিল তখনো ঢাকার বাজার ছিল ইতিবাচক। নির্বাচন ঘিরেও এমন কিছু হতে পারে। তবে হ্যাঁ, একটা বিষয়ে এখানেও সাবধান থাকতে হবে। কেউ কেউ হয়তো অর্থ ঢুকিয়ে কৃত্রিমভাবে বাজারকে প্রভাবিত করে দাম বাড়িয়ে কেটে পড়তে পারে। এদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাবধান থাকতে হবে। অর্থাৎ কোনো রিউমার বা গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনলে তাতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

বৈশ্বিক প্রভাব অর্থাৎ ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ঘিরে বাজারে কোনো প্রভাব পড়তে পারে কি?

: হ্যাঁ, এটা একটা দুশ্চিন্তার বড় জায়গা। কারণ এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। তাতে বাংলাদেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। জ্বালানির দাম বাড়লে উৎপাদনমুখী কারখানায় এর প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি রপ্তানি কমে আসতে পারে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ স্থায়ী হলে মধ্যপাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও কমে আসবে। তাতে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর এমন হলে পুঁজিবাজারেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।