আপডেট : ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ১৩:৩৩
আবেদনে ‘ভুল’ ধরে ঘুষে নিষ্পত্তি!
রাব্বিউল হাসান, জয়পুরহাট 

আবেদনে ‘ভুল’ ধরে ঘুষে নিষ্পত্তি!

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি জমা দিতে গেলে ভুল থাকার অজুহাত দেখিয়ে গ্রাহকদের হয়রানি করা হয় দিনের পর দিন। আবার কাঙ্ক্ষিত অঙ্কের টাকা দিলে ওই দিনই হয়ে যায় কাজ। অনিয়ম যেন নিময় হয়ে দাঁড়িয়েছে জয়পুরহাট পাসপোর্ট অফিসে, যেখানে ঘুষ ছাড়া পাসপোর্ট মেলে না। সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেয়ার পরও অতিরিক্ত দেড় থেকে তিন হাজার টাকা না দিলে হয়রানিতে পড়তে হয় পাসপোর্ট গ্রাহকদের।

অনলাইনে করা আবেদন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সরাসরি জমা দিতে গেলে ভুল থাকার অজুহাত দেখিয়ে গ্রাহকদের হয়রানি করা হয় দিনের পর দিন। আবার কাঙ্ক্ষিত ঘুষ দিয়ে দালাল চক্রের মাধ্যমে কাগজপত্রসহ আবেদন জমা দিলে ছবি ও আঙুলের ছাপ নেয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে। হয়রানির কারণে ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট করতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রাহকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মিত, জরুরি ও অতি জরুরি ক্যাটাগরিতে পাসপোর্ট সরবরাহ করার জন্য সরকারি ফি নির্ধারিত আছে। কিন্তু পদস্থ কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা অথবা জনপ্রতিনিধিদের তদবির ছাড়া শুধু সরকারি ফি নিয়ে পাসপোর্ট সরবরাহ করার নজির খুবই কম এই অফিসে। বেশির ভাগ পাসপোর্টই সরবরাহ করা হয় দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাওয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে।

১০ বছর মেয়াদের সাধারণ পাসপোর্টের জন্য সরকারি ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা হলেও দালালরা গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করে ৮ হাজার টাকা। আর জরুরি হলে নির্ধারিত ফির চেয়ে অন্তত ৪-৫ হাজার টাকা বেশি গুনতে হয় গ্রাহকদের। দালালের সঙ্গে চুক্তি করে আবেদন করলে কোনো হয়রানিতে পড়তে হয় না।

আবেদন করার দিনই তাদের ছবি ও আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। দালাল অথবা বাড়তি টাকা ছাড়া নানা অজুহাতে গ্রাহকের আবেদন গ্রহণ করেন না অফিস সহকারী লিপটন তালুকদার। কোনো কোনো গ্রাহক তার বিরুদ্ধে অশোভন আচরণেরও অভিযোগ করেন। অফিসের গেটে থাকা আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। অফিস সহকারীর ফিরিয়ে দেয়া আবেদন গ্রহণ করতে গ্রাহকদের অতিরিক্ত টাকা দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন আনসার সদস্যরা। তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে টাকা দিলেই ভুল ধরে বাতিল করা আবেদন আবার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণ করা হয়।

পাসপোর্ট অফিস ঘিরে ১০ থেকে ১২ সদস্যের দালাল চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তাদের মধ্যে জয়পুরহাট সদরের খঞ্জনপুর এলাকার নাহিদ ও রাকিব, সদরের রবিউল, মামুনুর রশিদ এবং পাঁচবিবির মেহেদীর নাম জানা গেছে। যাদের সঙ্গে অফিস সহকারী লিপটন তালুকদারসহ কর্মচারী, আনসার সদস্য ও অন্যরা পাসপোর্ট সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন।

জয়পুরহাট পৌর শহরের সবুজ নগরের বাসিন্দা আহসান হাবিব বলেন, ‘পাসপোর্টের আবেদন জমা দিয়ে ছবি ও আঙুলের ছাপ দিতে গেলে তিনি হয়রানির শিকার হন। অতিরিক্ত টাকা দিলে ফরম জমাদানের দিনই পাসপোর্টের ইনরোলমেন্ট হয়। টাকা না দিলে আবার ছবি তোলা ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার জন্য অন্য দিন যেতে হয়। যে ফরম জমা নেয়, সে নির্ধারণ করে দেয়। হয়রানির কারণে বাধ্য হয়ে আমাকে অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে।’

আরেক ভুক্তভোগী কালাই উপজেলার এম এন রায়হান বলেন, ‘আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিলে, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তোলার সময় দেয় ১০-১৫ দিন পরে। দালাল, অফিস স্টাফ, আনসারদের ১ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত দিলে সেই দিনই ছবি তোলে এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়। যে ফরম জমা নেয়, সব সময় ভুল খোঁজে মানুষকে ট্র্যাপে ফেলার ধান্দায় থাকে। টাকা না দিলে তারা সেটা করে না। বলে আবার ফরম পূরণ করে নিয়ে আসুন। তো আবার ফরম পূরণ করতে হলে, আগের করা আবেদনটি বাতিল করাতে হয়। সেটা করাতে আবার ১৫-২০ দিন সময় নেয়। টাকা দিলে আর কোনো সমস্যা হয় না। ফরম পূরণে শত সমস্যা থাকলেও টাকা দিলে সব সমস্যা নিমিষেই সমাধান হয়ে যায়।’

এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস সহকারী লিপটন তালুকদারকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

জয়পুরহাট পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক এ কে এম মোতাহার হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘অনলাইনে আবেদন শুরু হওয়ার পর পাসপোর্টে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। বাড়িতে বসেই যে কেউ আবেদন করতে পারেন। আবেদনের জন্য অফিসে আসতে হবে কেন? এ নিয়ে কারও কোনো লিখিত অভিযোগও পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’