মো. সবুজ হোসেন, নওগাঁ
প্রবাদে আছে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। কিন্তু নওগাঁয় প্রাথমিক স্তরেই সেই শিক্ষাকার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষকসংকটে। একটি-দুটি নয়, এই জেলায় প্রধান শিক্ষক নেই ৩০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এ ছাড়া ৫২০টি সহকারী শিক্ষকের পদও শূন্য এই জেলায়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসও সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছে।
নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এ জেলায় মোট ১ হাজার ৩৭৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০টি সরকারি প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। নওগাঁ সদর উপজেলায় ২১টি, আত্রাই উপজেলায় ৩৮টি, ধামইরহাট উপজেলার ২৫টি, নিয়ামতপুর উপজেলায় ১৭টি, পত্নীতলা উপজেলায় ২৬টি, পোরশা উপজেলায় ১৩টি, বদলগাছী উপজেলায় ৩০টি, মহাদেবপুর উপজেলায় ৪৬টি, মান্দা উপজেলায় ৪২টি, রানীনগর উপজেলায় ৩৪টি এবং সাপাহার উপজেলায় ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। এ ছাড়া এ জেলায় ৫২০ জন সহকারী শিক্ষকের পদও শূন্য।
নওগাঁর বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক শূন্যতার কারণে বিদ্যালয়গুলোয় কর্মরত সহকারী শিক্ষকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এ ছাড়া তাদের অতিরিক্ত পাঠদানের পাশাপাশি ও দাপ্তরিক কাজে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে।
মান্দা উপজেলার চকশ্রীকৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বাদশা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে ১৮৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক পাঁচজন। দাপ্তরিক কাজেই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।’
মহাদেবপুর উপজেলার শালগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাহিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রায় দুই বছরের মতো হলো প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য। প্রধান শিক্ষক না থাকায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাকে দাপ্তরিক কাজ, শিক্ষা অফিসে বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের কাজে যেতে হয়। আবার পাঠদানও করাতে হয়। আমাদের বিদ্যালয়ে মোট ১৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আমিসহ শিক্ষক পাঁচজন।’ একই কথা নওগাঁ সদর উপজেলার চকএনায়েত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শামীমা নাছরিনেরও।
যা বলছেন অভিভাবক ও বিদ্যালয়সংশ্লিষ্টরা
মান্দার শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের জয়ন্ত সরকার বলেন, শ্রীকৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার মেয়ে পড়াশোনা করে তৃতীয় শ্রেণিতে। সেখানে মাত্র পাঁচজন শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেশি ক্লাস নিতে পারেন না বলে আমার মেয়ে বলেছিল আমাকে। আর একই শিক্ষককে অনেকগুলো ক্লাস নিতে হয়, যার কারণে ঠিকমতো পাঠদান হয় না। বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত।’
মহাদেবপুর উপজেলার শালগ্রামের মিজানুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে শালগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। প্রধান শিক্ষক নেই, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছেন, তাকে তো বেশির ভাগ সময় দাপ্তরিক কাজ করতে হয়। চারজন শিক্ষক দিয়ে কীভাবে স্কুল চলে? আমার ছেলে মাঝে মাঝে বলে, একজন স্যার অনেকগুলো ক্লাস নেন।’
সদর উপজেলার চকএনায়েত মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি আবু মো. বখতিয়ার ইনাম ববিন বলেন, প্রধান শিক্ষকসহ আরও দুই শিক্ষক খুবই প্রয়োজন। এতগুলো শিক্ষার্থীর পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষকসংকটের কারণে। অভিভাবক হিসেবে দাবি করছি, যেন দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। আত্রাই উপজেলার নবাবের তাম্বু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাফিউল ইসলামও বললেন, প্রধান শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
এই অবস্থার ঠিক বিপরীত দৃশ্য প্রধান শিক্ষক ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক থাকা বিদ্যালয়গুলোর। এমনই একটি বিদ্যালয় নওগাঁ সদর উপজেলার চররামচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হোসনে আরা রিতা বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক আসমাতুন নাহারের আন্তরিকতায় আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ভালোভাবেই চলছে। ক্লাসের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। করোনায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন অনেকটা ভালো। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আনন্দের সঙ্গে পড়াশোনা করছে। রেজাল্টও ভালো।’
এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্থানীয় ফারহানা খাতুনের যমজ মেয়ে। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়েরা চররামচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েরা বিদ্যালয়ে আনন্দের সঙ্গেই যায়। পড়াশোনায়ও ভালো। শিক্ষকরাও খুব আন্তরিক। অভিভাবক হিসেবে বিদ্যালয়টি নিয়ে কোনো রকম অভিযোগ নেই।’
বদলগাছী উপজেলার বিলাসবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সঠিকভাবে পাঠদান করানোর। বাচ্চাদের পরম আনন্দের সঙ্গেই আমরা পাঠদান করাই। তারাও হাসিখুশিতে আসে। শিক্ষক বা অন্যান্য সংকট নেই।’
শাম্মী আক্তার নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘বিলাসবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে। শিক্ষার মান ভালো। শিক্ষকরাও খুবই আন্তরিক। মাঝেমধ্যেই আমাদের নিয়ে অভিভাবক মিটিং করে। আমরাও নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকি।’
সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মমিনুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, নওগাঁ জেলায় মোট ১ হাজার ৩৭৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ৩০০টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। এ ছাড়া ৫২০ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদগুলো শূন্য থাকার বিষয়টি আমরা শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর লিখিতভাবে জানিয়েছি। চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত এ সমস্যার সুরাহা হবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা