আপডেট : ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ ১৪:০২
কী ঘটতে যাচ্ছে কাল?
শেখ শফিকুল বারী

কী ঘটতে যাচ্ছে কাল?

দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঘিরে কী ঘটতে যাচ্ছে আগামীকাল? এ নিয়ে দেশব্যাপী চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মানুষের মনে ততই বাড়ছে শঙ্কা, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা।

ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নয়াপল্টনে তাদের কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। দুই দলই তাদের সমাবেশ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি হামলা বা ভাঙচুরের মতো কোনো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে তারা শক্ত হাতে তা প্রতিহত করবে।

এদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জানিয়েছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী কোনো মহল নাশকতার চেষ্টা করলে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। কালকের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে।

অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা তাদের ঘোষণা অনুযায়ী বায়তুল মোকাররম ও নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে। এক পক্ষ সরকার পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। অপর পক্ষ বর্তমান সরকারের অধীনেই সংবিধান সম্মতভাবে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

এ অবস্থায় নগরবাসীর মনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। কারণ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলের নেতারাই গত কদিন ধরে একে ওপরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা নিজ কার্যালয়ের সামনেই সমাবশে করবেন, অন্য কোনো স্থানের কথা তারা চিন্তাও করছেন না। আর তাতে বাধা দিলে সারা ঢাকা শহরে নেতাকর্মীদের ছড়িয়ে পড়তে বলছেন তারা।

এদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ওই দিনই মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) চিঠি দিয়েছে।

কিন্তু ডিএমপি জামায়াতের সমাবেশের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে। কোনোভাবেই ঢাকা শহরে অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না বলে তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া জনদুর্ভোগ কমাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রাস্তায় সমাবেশ না করে অন্য স্থান দেখতে বলেছে ডিএমপি।

কিন্তু জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দিলে তারা বিএনপির সমাবেশে মিশে যেতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। কেউ কেউ বলছেন সমাবেশের অনুমতি না পেলে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে দলটি।

আওয়ামী লীগ বলছে, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটেই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা শান্তি সমাবেশ করবে। যদি বিএনপি বা অন্য কেউ ওই দিন সমাবেশের নামে অরাজকতা করে বা তাদের ওপর আক্রমণ করে তাহলে পাল্টা আক্রমণ করবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ওই দিন শহরের পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দলটি। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগামীকাল (শনিবার) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করাসহ ৭টি বিষয়ে পুলিশকে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।

বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ তার সই করা এ সংক্রান্ত চিঠি পল্টন মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সমাবেশে লোক সমাগম সকাল ১০টা থেকে শুরু হবে এবং সন্ধ্যা ৭টায় শেষ হবে। সমাবেশে প্রায় ২ লাখ লোক সমাগম হবে বলে তারা জানিয়েছে। সমাবেশটি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে পল্টন মোড়, জিপিও মোড়, শিক্ষা ভবন, গোলাপ শাহ মাজার, নগর ভবন, নবাবপুর সড়ক, মহানগর নাট্যমঞ্চ সড়ক, দৈনিক বাংলা মোড় এবং মতিঝিল সড়ক, স্টেডিয়াম সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হবে বলে তারা চিঠিতে উল্লেখ করেছে।

এ পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের কথা মনে করছেন অনেকেই। ওই দিন ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। ওই দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের বিষয়টির ফয়সালা হয়নি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের বিষয়ে ছিল অনড়। সে সময় ২৮ অক্টোবর সামনে রেখে ঢাকা শহরে ছিল টানটান উত্তেজনা। আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং নেতা-কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে আসতে বলে। বিএনপি ওই দিন নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ও জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের কর্মসূচি নেয়। দুই পক্ষের মধ্যে সেদিন ব্যাপক সংঘাতের ঘটনায় বেশ কিছু প্রাণহানি ঘটেছিল।

এদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশের বিষয়ে ডিএমপির অবস্থান তুলে ধরেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আগামী ২৮ তারিখে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকা সমাবেশের বিষয়ে জিরো টলারেন্স। কোনোভাবেই ঢাকা শহরে জামায়াতকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। আর জনদুর্ভোগ কমাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রাস্তায় সমাবেশ না করে অন্য স্থান দেখতে বলেছে ডিএমপি।

যুগ্ম কমিশনার বলেন, যারা ঢাকা শহরে সভা-সমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাদের রাস্তায় নয়, রাস্তা বাদ দিয়ে অন্যত্র উন্মুক্ত স্থানে সমাবেশ করার কথা বলা হয়েছে। সেটা খোলা স্থান বা মাঠও হতে পারে।

তিনি বলেন, ঢাকা একটি মেগা সিটি। এখানে যদি লাখ লাখ লোকের সমাবেশ হয়, তাহলে দুই-আড়াই কোটি নগরবাসীর সমস্যা হয়, যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে যেতে সমস্যা হয়। ঢাকাবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য কোনো জায়গায় করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। অন্য কোথায় তারা সমাবেশ করবে, সেটি তারাই নির্ধারণ করুক।

বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে একই রকম চিঠি দেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আর রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অন্যত্র সমাবেশ করার কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। আমরা আশা করছি, রাজনৈতিক দলগুলো নগরবাসীর ভোগান্তি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা পল্টনেই সমাবেশ করবেন। যদি তারা এ সিদ্ধান্তেই অটল থাকে, তাহলে ডিএমপির অবস্থান কী হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতারা অনেক সময় মাঠ গরম করা বা কর্মীদের চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে অনেক ধরনের কথা বলেন। তা আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি না। আমরা বিবেচনা করছি আইনসংগত কথা।’

ডিএমপি কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মহানগরে সমাবেশ করতে হলে অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনারের অনুমতি নিতেই হবে। এটি আইনিভাবেই বাধ্যতামূলক। কেউ যদি সেটা না করে, তবে তা আইনের বরখেলাপ হবে। সুতরাং আমরা আশা করব, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে, পুলিশকে সহযোগিতা করবে।

ওই দিন শাপলা চত্বরে জামায়াতের ডাকা সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিপ্লব কুমার বলেন, জামায়াতের বিষয়ে ডিএমপির অবস্থান লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। জামায়াতকে ঢাকা শহরের কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল। দলটির নিবন্ধন হাইকোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন বাতিল করেছে। সুতরাং জামায়াতকে কোনো ধরনের স্পেস দেয়ার সুযোগ নেই। জামায়াত কোনো স্পেস পাবে না। তাদের বিষয়ে সহযোগিতা নয়, শূন্য সহিষ্ণুতার (জিরো টলারেন্স) নীতি। এরপরও যদি তারা অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করতে চায়, তাহলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘এটি মিথ্যা কথা। কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ ঘিরে ডিএমপি কাউকে গ্রেপ্তার করে না। আমাদের ক্রাইম ডিভিশনের প্রত্যেক থানার ওসি ও ডিসিকে বলা আছে, যারা ওয়ারেন্টের আসামি, সন্দেহজনক আসামি, মামলা বা তদন্তভুক্ত আসামি, নাশকতা হতে পারে এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য বলা হয়েছে। এর বাইরে অন্য সাধারণকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করার সুযোগ নেই।’

একই ধরনের পরিস্থিতিতে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) পল্টন ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। রাজধানীজুড়ে প্রায় ১৫ হাজারের মতো পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তারপরও সেদিন সংঘাত বন্ধ ছিল না। ওই দিন বায়তুল মোকাররম এলাকায় ১৪ দলীয় জোট ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরের চার কর্মী ও ওয়ার্কার্স পার্টির এক কর্মী মারা যান। ওই দিন সারা দেশে ১১ জন নিহত হন।

এ অবস্থায় নগরবাসীর মনে শঙ্কা বিরাজ করছে। সবার মনেই প্রশ্ন- কী হবে কাল রাজধানী ঢাকায়? অনেকেই ভাবছেন, কালকের সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে সংঘাত-সংঘর্ষসহ যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আর এ প্রেক্ষাপটে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।