‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার গরুর গাড়িতে’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায়’ ইত্যাদি কালজয়ী গান যাঁর কণ্ঠে এখনো দর্শক হৃদয় ছুঁয়ে আছে, তিনি নন্দিত গায়ক এন্ড্রু কিশোর। গুণী এই শিল্পী চার দশক ধরে সিনেমার গানে জড়িয়ে ছিলেন।
এন্ড্রু কিশোরের গানে হাতেখড়ি হয় ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। চ্যানেল আইয়ের ‘সাময়িকী’ নামের এক অনুষ্ঠানে গানের জগতে আসার পেছনের গল্প শুনিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। গানের পোকা কীভাবে তাঁর মাথায় ঢোকে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার গানের হাতেখড়ি স্কুলের শিক্ষক ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। তিনি আমাদের পরিবারের বন্ধু ছিলেন।’
তিনি ছোটবেলায় ভাবতেন আমি হয়তো ক্লাসিক্যাল সিঙ্গার হব। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমার যখন কণ্ঠ পরিবর্তন হলো, অ্যাডাল্ট বয়সে এলাম। তখন ওপার বাংলার সঙ্গে মিশে চলচ্চিত্রের গান, হিন্দি গান আয়ত্ত করা শুরু করি। ধ্রুব সংগীত যেটাকে বলে।
আমি ধ্রুব সংগীতে বেশ পারদর্শিতাও অর্জন করে ফেলি। গান গেয়ে মঞ্চে তালি পাচ্ছি, তখন আস্তে আস্তে কখন আমি ক্লাসিক্যাল থেকে টার্ন আউট হয়ে গেছি, নিজেও জানি না। তখন এক সন্ধ্যায় ক্লাসিক্যাল সংগীতের আসরে আমার ওস্তাদ বললেন, ‘তোকে দিয়ে হয়তো ক্লাসিক্যাল হবে না, তুই আধুনিক গানের দিকেই চলে যা।’ সেই থেকে আধুনিক গানের দিকে আসা। সে সময় ওস্তাদ আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, ‘আধুনিক গান খুব সাধারণ জিনিস।
এখানে শেখার এমন কোনো ব্যাপার নেই। যেটা ক্লাসিক্যালে আছে। ক্লাসিক্যালে অনেক কিছু শিখতে হয়। আধুনিক গান সবাই গাইতে পারে, কিন্তু তোর সঙ্গে তফাত হবে কোথায়? তুই যে গায়ক, তোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের তফাতটা হবে তোর গান মানুষের হৃদয়ে স্পর্শ করতে হবে।’ এই বিষয়টা যখন ওস্তাদজি আমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন তার পর থেকে গানের প্রতি আলাদা ঝোঁক তৈরি হয়।’
এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীর ছেলে। সেখান থেকে চলচ্চিত্রের গানে যুক্ত হওয়ার গল্পও শোনান ওই অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমি রাজশাহীর ছেলে। আমাদের স্কুলের আরেকজন ছাত্র ছিল, এ এইচ এম রফিক, যিনি চিফ মিউজিক প্রডিউসার ছিলেন। তিনি ভাবলেন, রাজশাহী রেডিওর জন্য আমার গলা খুব উপযুক্ত নয়। আমার কণ্ঠটা চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর চেষ্টায় আমার ঢাকায় আসা। তিনি যখন ঢাকায় আসতেন আমাকে টেনে টেনে নিয়ে আসতেন। সে সময় রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বলে একটা সেল ছিল। যেটা খুব জনপ্রিয় ছিল। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল মফস্বল স্টেশনের যারা জনপ্রিয় সিঙ্গার তাদের ঢাকায় এনে গানগুলো ধারণ করে, সেটা সমগ্র দেশের রেডিওতে ছড়িয়ে দেয়া। সেই পদক্ষেপেই আমার উঠে আসা। সেখান থেকেই চলচ্চিত্রের গানে চলে যাওয়া।’
১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায় ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর মুকুল চৌধুরীর কথায় ও আলম খানের সুরে ‘এক চোর যায় চলে’ গানের পর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তাঁর গাওয়া আরও উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে- ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘প্রেমের সমাধি ভেঙে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি ছিলে মেঘে ঢাকা চাঁদ’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমার মাঝে খুঁজে পেয়েছি’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘তুমি আজ কথা দিয়েছো’, ‘কী জাদু করেছ বলো না’, ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ চলচ্চিত্রের ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানের জন্য তিনি প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান। সৈয়দ শামসুল হকের কথায় গানটির সুরকার ছিলেন আলম খান। এরপর ‘ক্ষতিপূরণ’ (১৯৮৯) চলচ্চিত্রে ‘আমি পথ চলি একা এই দুটি ছোট্ট হাতে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ (১৯৯১) চলচ্চিত্রে ‘দুঃখ বিনা হয় না সাধনা’, ‘কবুল’ (১৯৯৬) চলচ্চিত্রে ‘এসো একবার দুজনে আবার’, ‘আজ গায়ে হলুদ’ (২০০০) চলচ্চিত্রে ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘সাজঘর’ (২০০৭) চলচ্চিত্রে ‘সাজঘর’, ‘কী জাদু করিলা’ (২০০৮) চলচ্চিত্রে ‘কী জাদু করিলা’ গানের জন্য শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
ভারতের খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক আর ডি বর্মণের সুরে ‘সুরজ’ নামে সিনেমায় এন্ড্রু কিশোর হিন্দি গান গেয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁর সুরে আরও দুটি বাংলা গান করেছেন। ২০২০ সালের ৬ জুলাই মারা যান কিংবদন্তি এই কণ্ঠশিল্পী।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা