আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক করতে মনোনয়নবঞ্চিত দলের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ উন্মুক্ত রাখল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গতকাল রোববার দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর পাশাপাশি দলের অন্য যেকোনো নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দলীয় প্রতীকের প্রার্থীর পাশাপাশি দলের যেকোনো নেতা বা যেকোনো ব্যক্তি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন বলে দলীয় সভাপতির নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী। সুতরাং স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা থাকছে না দলের পক্ষ থেকে। সভায় উপস্থিত একজন জানান, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে প্রয়োজনে ডামি প্রার্থী রাখতে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। একই সঙ্গে নির্বাচনের সময় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতেও নির্দেশ দেন তিনি।
পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আনতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তাগাদা দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সতর্ক করে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ পাস করে আসতে পারবেন না। অন্য দলের প্রার্থী না থাকলে প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে নৌকার প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা অন্যান্য দলের কেউ প্রার্থী হলে তাকেও সহযোগী ও উৎসাহ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
সভায় আওয়ামী লীগের প্রধান সবার কাছে ৩০০ প্রার্থীর নাম দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু উপস্থিত সবাই সে দায়িত্ব সভানেত্রীকেই প্রদান করেন। সেই সঙ্গে আরও জানা যায়, যে কেউ চাইলেই নির্বাচন করতে পারবেন। কোনো বাধা নেই। এ সময় মনোনয়প্রত্যাশীদের পাশাপাশি দলের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিরোধী দল না আসা সাপেক্ষে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করতে প্রয়োজনে আসন উন্মুক্ত করা হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পরে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য জানান, দলীয় প্রার্থী হিসেবে যাদের মনোনয়ন দেয়া হবে, তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি সবাই যেন ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানান, সেই বিষয়টিও মনিটরের কথা বলা হয়েছে। মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর পাশাপাশি ডামি ক্যান্ডিডেটও (বিকল্প প্রার্থী) রাখতে বলেছেন, যেন কারও মনোনয়ন বাতিল বা মনোনয়ন প্রত্যাহার করলে যেন ডামি ক্যান্ডিডেট নির্বাচন করতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে জানান, নেত্রী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য বলেছেন। বিকল্প প্রার্থী রাখতে বলেছেন, নির্বাচনে যাতে কেউ কোনো ধরনের অনিয়ম করতে না পারে। ভোটারের উপস্থিতি যাতে বাড়ে, সে জন্যও কাজ করতে বলেছেন।
এদিকে দলীয় সভাপতির বক্তব্যের বিষয়ে সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতেই চলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের কোনো মুরব্বি নেই, আমাদের মুরব্বি জনগণ। আমাদের অগণিত নেতা-কর্মী আছে, জনগণের সমর্থন আছে। কারও তোষামোদি করে ক্ষমতায় থাকতে হবে- সেই রাজনীতি বঙ্গবন্ধুকন্যা করে না।’
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছে টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের করা বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকায় দেশের মানুষ শান্তি পেয়েছে, স্বস্তি পেয়েছে, মানুষ ভালো থাকতে শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনে জনগণ আমাদেরকে ভোট দিলে, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করছি। দলমত নির্বিশেষে সবার দায়িত্ব আমার। তারা আমার পরিবার।
এ সময় বিএনপিকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ওপর তাদের আস্থা-বিশ্বাস নেই। সে জন্য তারা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করছে। এ সময় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশও প্রদান করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত দুষ্টচক্র যেন মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে না পারে, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ মাটি আমাদের। এখানে কারও খবরদারি বরদাশত করা হবে না। জনগণই আমাদের শক্তি এবং আমরা কারও ওপর নির্ভরশীল নই।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার মেয়ে হিসেবে তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর দল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান।’
এর আগে সকাল থেকেই গণভবনের প্রবেশ পথে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করতে সকাল থেকে নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে তারা সারিবদ্ধভাবে গণভবনে প্রবেশ করেন। নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে ভেবেই উচ্ছ্বসিত ছিলেন তারা।
গত ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা নেয়ার কাজ চলে। পরে গত বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার দলের মনোনয়ন বোর্ড বসে ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে কারা ভোটের মাঠে নামছেন, তা রোববার বিকেলে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে নতুন মুখ যেমন এসেছে, তেমনি আগের কেউ কেউ বাদ পড়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সাল থেকেই মহাজোট গঠন করে নির্বাচন করছে আওয়ামী লীগ। এবারও তারা জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেও কারা জোটে থাকবে এবং জোটের কারা কোন আসন পাচ্ছেন, এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য মেলেনি।
এর আগে গত ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেখানে ৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ রেখে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ রাখা হয়েছে ৩০ নভেম্বর। এরপর মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি তারিখ ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা