সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত দলবদলে ২০০৯ সালের জুনে কাকা ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দলে টেনেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ফ্লোরেন্তিনো ছুটে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। হাজির হয়েছিলেন ইউরি গ্যাগরিন সড়কের ৩৩ নম্বর বাসায়।
২১ বছর বয়সী লিওঁর এক স্ট্রাইকার তার লক্ষ্য। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনও তাকে দলে পেতে চান। পেরেজ তাই লোভ দেখালেন, বললেন বিশ্বের সেরা খেলায়াড় হওয়ার যোগ্যতা আছে তার এবং রিয়াল মাদ্রিদই পারবে সেটা অর্জনে সহযোগিতা করতে।
আগ থেকেই রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন করিম বেনজেমা। তার দুই আদর্শ এই ক্লাবেই খেলেছেন। কাকা ও রোনালদোকে মাত্রই দলে টানা এক দল তাকে বিশ্বের সেরা বানানোর কথা বলছে? দুবার ভাবতে হয়নি তাকে।
লিওঁর সেই তরুণের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে পরশু। অপেক্ষাটা একটু দীর্ঘ হলো, এই যা। ‘মাত্র’ ১৪ বছর। থিয়েখ্ দু শাতেলে যখন আদর্শ জিনেদিন জিদানের হাত থেকে সোনালি বলটা বুঝে পেলেন, প্রথমে কিছুক্ষণ কিছু বলতে পারেননি। আমন্ত্রিত অতিথিদের ‘করিম’, ‘করিম’ শোর থেমে এলে বললেন, ‘এটা পেয়ে সম্মানিত, একটা শিশুর স্বপ্ন সত্য হলো; একদিন বালন দ’র জিতব।’
সে স্বপ্ন পূরণ হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। ২০১৭-১৮ মৌসুমে এক শব্দে রিয়ালের সব খেলোয়াড়কে বর্ণনা করতে বলা হয়েছিল জিদানকে। কিংবদন্তি বেনজেমার বেলায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ম্যাজিক’। তার সে কথায় যা হয়েছিল, তার বর্ণনায় সৈয়দ মুজতবা আলীর সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। কারণ, হাসির রোল শুধু ভূমধ্যসাগর নয়, সব সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বের সব প্রান্তেই পৌঁছে গিয়েছিল। লিগে মাত্র ৫ গোল করা এক স্ট্রাইকার নাকি ‘জাদুকর’!
পরশু পডিয়ামে দাঁড়িয়ে তাই বেনজেমা বলছিলেন, ‘আমার যাত্রা নিয়ে গর্বিত, এটা সহজ ছিল না। আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য খুব কঠিন ছিল।’
যাত্রা পথটা কঠিন হওয়ার দায় কিছুটা নিজের, কিছুটা ভাগ্যের। সেরা হতে গিয়েছিলেন রিয়ালে, যেখানে সেবারই যোগ দিয়েছেন রোনালদো। নিজেকে সেরা প্রমাণের মতো স্বার্থপর কখনোই ছিলেন না, রোনালদোর জন্য আলোটা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন আড়ালে। প্রকৃত এক গোলশিকারির সঙ্গে এমন আচরণ যায় না বলে ক্ষিপ্ত কোচ জোসে মরিনিও তাকে বিড়ালের সঙ্গেও তুলনা দিয়েছেন।
নিজেকে কখনোই শুধুই নম্বর নাইন হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন ফুটবলার হিসেবে। কিন্তু যার পিঠের জার্সি নম্বর ৯, তার কাছ থেকে গোলই আশা করেন সবাই। রোনালদো-বেলের সঙ্গী হয়ে তাদের সহযোগিতাতেই মন দিতে গিয়ে তা আর ওভাবে করা হতো না।
শুধু রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ পর্ব সাঙ্গ হওয়ার পরই বেনজেমার প্রকৃত রূপটা দেখা গেছে। ৯ বছর পর বোঝা গেছে বেনজেমাও আলো কাড়তে জানেন, রিয়ালের মতো ক্লাবকে টানতে পারেন। সমর্থকদের সমালোচনার মাঝেও নিজের ওপর কখনো আস্থা হারাননি বলেই হয়তো, ‘যা করেছি তাতে গর্বিত, আমি কখনো হাল ছাড়েনি।’
এখনো আগের মতো দলের খেলা সৃষ্টিতে মনোযোগ দেন, মাঝমাঠে নেমে খেলা গড়ে দেন আর রোনালদোর মতো কারও জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে না বলে গোলটাও করেন সমর্থকদের তৃপ্তি মিটিয়ে আদর্শ হিসেবে যাদের বেছে নিয়েছেন, তারা যে এই শিক্ষাটাই দিয়েছেন, ‘জীবনে দুজন আদর্শই ছিল আমার, জিদান এবং রোনালদো (নাজারিও)। আমি খুব খুশি যে রোনালদো এখানে আছেন। আমি সবসময় তার মতো হতে চেয়েছি।’
একদিক থেকে নিজের আদর্শকেও ছাড়িয়ে গেছেন। রোনালদোকে তার মতো এতটা চাপ নিয়ে কখনো খেলতে হয়নি রিয়ালে। চার বছর ধরেই রিয়ালকে টানছেন। তবে গত মৌসুমটা এর মধ্যেও অনন্য। ক্লাবের হয়ে ৪৬ ম্যাচে ৪৪ গোল করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ১৫ গোল। ক্লাবকে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতিয়েছেন। ৬ বছর পর জাতীয় দলে ফিরে করেছেন আরও ১০ গোল। প্রত্যাবর্তনের বছরেই দেশের হয়ে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফিও (নেশনস লিগ) জিতেছেন।
এমন এক মৌসুমের পর বালন দ’র যে বেনজেমাই জিতবেন, সেটা জানতেন সবাই। জানতেন বেনজেমাও, ছোটবেলা থেকেই তো এর স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছেন। একটু দেরি হলো, এই যা!
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা