আপডেট : ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:২৫
‘আই হসপিটালের ভাত খাইনা, বাড়িত্তুন আনি খাই’
খোরশেদ আলম, সোনাইমুড়ী (নোয়াখালী)

‘আই হসপিটালের ভাত খাইনা, বাড়িত্তুন আনি খাই’

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতালে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের। ছবি: দৈনিক বাংলা

‘আই হসপিটালের ভাত খাইনা, বাড়িত্তুন আনি খাই। হসপিটালের জান বাচাইন্না খাবার মুখে ঢুকে না। হঁচা গন্ধে ভাত খাইতে মন চায় না।’ আক্ষেপের সঙ্গে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ৫০ উর্ধ্ব সাহজাহান। প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে গত দুই দিন থেকে ভর্তি আছেন সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতালে। এসেছেন সোনাইমুড়ীর মাহোতোলা এলাকা থেকে।

হাসপাতালে ১৪ নং বেডে ভর্তি আছেন ৬০ বছরের আব্দুল মান্নান। তিনি হাসপাতালের খাবার নিয়ে বলেন, হাসপাতাল থেকে যে খাবার দেওয়া হয় তা মুখে নেওয়া যায় না। তিনি খাওয়া নেন না। হলুদ, মরিচ নেই শুধু পানি দিয়ে রান্না করে রোগীদের দেওয়া হয়। এজন্য বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খান।

আরেক রোগী নাম আবুল কালাম (৭০)। গত শুক্রবার থেকে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি রয়েছেন ১৬ নাম্বার বেডে। পরিক্ষা-নিরিক্ষার পর তার কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। গত সোমবার দুপুরে খাবার হিসেবে তাকে দেওয়া হয় লাউ ও মুরগির মাংস। খেতে না পেরে পাশেই খাবার প্লেট রেখে দিয়েছেন।

রুগীকে দেয়া খাবারের এরকমই চিত্র দেখা গেছে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালটিতে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের নিম্ন মানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ দীর্ঘ বছরের। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক শ্রেনীর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজেসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এধরনের অনিয়ম করে আসছে। ২০০৬ সালে নোয়াখালী সদর উপজেলার খান ট্রেডার্সের স্বত্তাধীকারী জহির খান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহের টেন্ডার নেন। পরে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তিকে সঙ্গে নিয়ে খাদ্য সরবরাহের পাওনা টাকার দাবিতে আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ করে রেখেছে চক্রটি। যার কারনে মামলা থাকায় টেন্ডার না হওয়ায় একই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ১৭ বছর থেকে এই হাসপাতালের রোগীদের খাদ্য সরবরাহ করে আসছে। তাই তো দীর্ঘ বছর তাদের ইচ্ছামত নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

একজন রোগীর জন্য প্রতিদিন খাবারে সরকারীভাবে ১৭৫ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তবে নিম্ন মানের খাবার সরবরাহ করায় তা খেতে পারেন না অধিকাংশ রোগীরা। অনেকেই খাবার না খেয়ে ফেলে দেন। আবার কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে খাবার না নিয়ে বাড়ি থেকে এনে খান। দরপত্র অনুযায়ী একজন রোগীর সকালের জন্য প্রতিদিন রুটি, একটি কলা, একটি ডিমের জন্য মোট ৩৬ টাকা ২৫ পয়সা বরাদ্দ রয়েছে। দুপুরে ও রাতে চিকন চালের ভাত, কারফু বা রুই মাছ, খাশি বা ব্রয়লার মুরগির মাংস, মুগডাল, ফুলকপি, গোলআলু, শিম ও পটলসহ সর্বমোট ১৭৫ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবার সরবরাহে মোটা চাল, নিম্ন মানের কলা, রুটি সরবরাহ করা হয়।

রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত বরাদ্দে প্রতিটি রোগীর জন্য সকালে ও দুপুরে যে ধরনের খাবার ও যে পরিমান খাবার সরবরাহের কথা রোগীরা সেই পরিমান খাবার পাচ্ছেন না। পরিবেশন করা সকল খাবারই নিম্ন মানের।

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাবুর্চি ওহিদুল আলম জানান, মাইজদি থেকে খান গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান গত ১৬-১৭ বছর থেকে রোগীদের খাবার সরবরাহ করে আসছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাওনা টাকার দাবিতে একটি মামলা থাকায় টেন্ডার হচ্ছে না। মামলা নিস্পত্তি করার জন্য কারো মাথা ব্যথা নেই। দলীয় লোকজন ফায়েদা লুটতে একটি গ্রুপ টেন্ডার হতে দেয় না। তাকে যা দেওয়া হয় তা দিয়েই তিনি খাবার রান্না করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাদ্য সরবরাহকারী প্রষ্ঠিান খান গ্রুপের স্বত্বাধিকারী জহির খান জানান, রোগীদের সিডিউল মোতাবেক খাবার সরবরাহ করছেন। হাসপাতালের ডাক্তাররা তা তদারকি করছেন। বকেয়া পাওনা থাকায় আদালতে মামলা রয়েছে বিধায় টেন্ডার হচ্ছে না।

সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডাক্তার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, তিনি ব্রেইন টিউমারের কারনে ছুটিতে আছেন। কোন তথ্য জানতে চাইলে অফিস থেকে নেওয়ার অনুরোধ করেন। তবে হাসপাতালে সরবরাহকৃত খাবার মান ভালো।

নিম্ন মানের খাবার ও দীর্ঘদিন টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইসরাত জাহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি মুঠোফোনে জানান, যে খাবার দেওয়া হয় তা নোয়াখালী জেলার অন্য সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ভালো। এখানে ওজন মেপে খাবার দেওয়া হয়। মামলা থাকায় টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তবে কত বছর টেন্ডার হচ্ছে না তা স্পষ্ট করে জানাননি তিনি।