আপডেট : ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:৩৯
নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও মাঠের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। তবে বিএনপির অনেক নেতাসহ নিবন্ধিত প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দলের অংশগ্রহণ এবং বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে রদবদল করে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বারবার আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে তারা সে বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি তথা হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মতো একটি জনসমর্থন থাকা বড় দল নির্বাচন থেকে দূরে থেকে কীভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে টিকে থাকবে, সেটাও এখন অনেকের মনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। এ পর্যন্ত যে অবস্থা, তাতে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি পরাজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। বিএনপি আগামী দিনের যেকোনো আন্দোলনের চিন্তাই তাদের জন্য বুমেরাং হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের সামনে অনেক কিছুই এখন পরিষ্কার। বিএনপি জোটের সামনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রই এখন অন্ধকার।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বশেষ বলা হয়েছে, কোনো চাপ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংহত থাকুক, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকশিত হোক। কারণ গণতন্ত্র হলো উন্নয়ন এবং উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি অর্থবহ ও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে বলছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এমনকি শর্ত প্রত্যাহার সাপেক্ষে বিএনপি সংলাপে এলে আওয়ামী লীগের সে বিষয়ে সম্মতি রয়েছে। উল্লেখ্য, দুটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কাজ করছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেবে না এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাও গ্রহণ করবে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সংলাপ এবং সমঝোতাকে সমর্থন করে।

বর্তমান যে অবস্থা তাতে পরিষ্কার বিএনপি ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো- তারা যেটা চেয়েছে এবং এখনো চাইছে, কিংবা ভবিষ্যতেও চাইবে মানে সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, সেটাও তো হলো না এবং হচ্ছে না। তাহলে এখন তারা কী করবে? কী হবে এখন তাদের রাজনৈতিক কৌশল? কোন পথে এগোবে তারা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে? মাঝখানে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা নির্বাচন হতে দেবে না বলে যে হুংকার দিয়েছিল সে কথা স্মরণে রেখেই বলা যায়, তারা তেমন কিছুই করতে পারবে না। এ ধরনের কর্মসূচি কিংবা লাগাতার অবরোধ-হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাহলে পরবর্তী কর্মসূচি বা দাবি আদায়ের পন্থা কী হবে? বিষয়টি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। তবে গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। তাতে এখন পর্যন্ত যে ফলাফলের কথা জানা যায়, সে অনুযায়ী নির্বাচন পর্যন্ত কঠোর কোনো কর্মসূচি দেয়া সম্ভব না হলে অবরোধ-হরতালের নামকাওয়াস্তে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে। বিএনপির বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার, কী পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তা দেখে নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে। এমনকি নির্বাচন যেমনই হোক না কেন, নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন প্রভৃতি দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে যদি দেখা যায় যে নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ প্রতিনিধিত্বশীল নয়, কিংবা ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে নির্বাচন করা যায়নি, সে ক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মসূচি আরও কঠোর এবং জোরদার করতে পারে বিএনপি। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাদের আন্দোলন জোরদার করবে?

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিকে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সেটা হলো দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। একটানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অনেক নেতাই নির্বাচনে যেতে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী হয়েছে। ফলে অনেক নেতাই নির্বাচনে আসার প্রক্রিয়ায় শরিক হয়েছেন।

নির্বাচন ঘিরে এখন আওয়ামী লীগের কৌশল কী? বিএনপিসহ বিরোধী শক্তিকে সামাল দিতে আওয়ামী লীগকেও তো পাল্টা কৌশল অবলম্বন করেই চলেছে। এখন পর্যন্ত সেই কৌশলে আওয়ামী লীগ শুধু যে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনকারী শক্তিকে সামাল দিয়েছে তা নয়, নির্বাচন ঘিরে দৃষ্টিকটুভাবে তৎপর হয়ে ওঠা বিদেশি শক্তিকেও সফলভাবে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। ধারণা করা যায়, নির্বাচন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক প্রমাণ করার জন্য ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সে লক্ষ্যে নানামুখী কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যত বেশিসংখ্যক প্রার্থীকে নির্বাচন করতে দেয়া যায় তার ব্যবস্থা করা।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের নির্বাচিত করে আনা; যা কিছুই বলা হোক না কেন, ওই নেতাদের নির্বাচনে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান, তাতে ১৪-দলীয় জোটের নেতাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের (নৌকা মার্কার) দুর্বল প্রার্থী দেওয়া হবে। তার ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হবে। এসবই করা হবে নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে; কিন্তু তাতে বাস্তবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাতে জোট নেতাদের জিতে আসা শুধু অনিশ্চিত নয়, অসম্ভবও হতে পারে। এমনকি জোট নেতাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে যদি নৌকা মার্কার প্রার্থী না-ও দেওয়া হয়; কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, সে ক্ষেত্রেও জোট নেতাদের বিজয় কঠিন হতে পারে। তেমন পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করবে সন্দেহ নেই। কাজেই নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জগুলোও যথেষ্ট ক্রিটিক্যাল। এখন দেখা যাক, এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়।

বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ চলাকালীন বিএনপির মধ্যে থেকেই একটি বড় অংশই এখন মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে নির্বাচন বর্জন হবে এক ধরনের হঠকারিতা। কারণ সরকার নির্বাচনমুখী প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের যে সাংগঠনিক দৃঢ়তা রয়েছে তাতে বিএনপির পক্ষে নির্বাচন প্রতিরোধ করা সাংগঠনিকভাবে সম্ভব হবে না। কারণ বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এক সময় বিএনপির সহসভাপতির দায়িত্বে থাকা শমসের মবিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তৃণমূল বিএনপির রাজনৈতিক পদক্ষেপ বিএনপির জন্য আরও একধাপ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির একের পর এক দুর্যোগে দলের ভিত হিসেবে পরীক্ষিত তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যেন কোনো আস্থার জায়গা পাচ্ছে না। দলের ভেতর সিদ্ধান্তহীনতা থাকায় কোনো ইস্যুকেই কাজে লাগাতে পারেনি। আগামী দিনে বিএনপির সামনে কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জকে কত গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে তার ওপরেই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনা।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।