আপডেট : ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০২
পেঁয়াজ নিয়ে তেলেসমাতি
মূল্য কারসাজির জন্য ১৩৩ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
সুলতান আহমেদ

পেঁয়াজ নিয়ে তেলেসমাতি

ভারতের রপ্তানি বন্ধের খবরে এক দিনে দেশের বাজারে পেয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বনানী কাঁচাবাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা। গতকাল শনিবার সকালে পেঁয়াজের দামের পরিস্থিতি জানতে বাজারে গিয়ে দেখা গেল এমন ঘটনা। ক্রেতার অভিযোগ, আগের দিন বিক্রেতা যে পেঁয়াজ বিক্রি করেছে ১৩০ টাকা কেজি দরে, তা এখন চাচ্ছেন ২৫০ টাকা কেজি। অন্যদিকে বিক্রেতা বলছেন, আড়তে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে তাই তাদের কিছুই করার নেই। ক্রেতা আনিস রহমানকে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই ক্ষোভ ঝাড়েন গণমাধ্যমের ওপরেও। ‘আপনারা সত্য কথা কেন তুলে ধরেন না! এইটা কোন দেশের বাজার পরিস্থিতি হতে পারে? এ দেশে বাজার দেখার জন্য কি কেউ নাই?’ এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী আনিস আরও জানান, ‘এক দিনে আগে যে জিনিস ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা শুধু ঘোষণায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই মানা যায় না। আমি শিওর এসব ব্যবসায়ীরা নতুন করে পেঁয়াজ কেনেননি, তবে দাম ঠিকই দ্বিগুণ করে দিয়েছেন’।

মিরপুরের একটি বাজারেও একই চিত্র পাওয়া গেল। দোকানদারদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা কাটাকাটি হচ্ছে ক্রেতাদের। সবারই প্রশ্ন- ভারত শুধু রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, এখন দোকানে যেসব পেঁয়াজ রয়েছে তা আগেই কেনা, তাহলে দাম বাড়বে কেন? যদিও এর কোনো সদুত্তর নেই বিক্রেতাদের কাছে। মধ্যবয়সি জলিল মিয়া জানান, খবর শোনার পর কিছু পেঁয়াজ কিনে রাখার জন্য বাজারে এসেছেন। ভেবেছেন ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হলে দাম বাড়তে পারে পেঁয়াজের। তবে তার চিন্তার চেয়েও বেশ আগেই যে বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। বলেন, ‘আমাদের চেয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি চালাক, আমরা যা ভেবেছি তার আগেই দাম বাড়িয়ে বসে আছে তারা। মিরপুরের বাজারগুলোতেও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে। অবশ্য এখনো যেসব ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে রয়েছে সেগুলোর দাম ১৮০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। এক দিনের ব্যবধানে কেন পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল এমন প্রশ্নের জবাবে বিক্রেতা কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা কিনে আনি আড়ত থেকে, আপনারা তাদের ধরেন। আমরা ভাই ছোট ব্যবসায়ী, আমরা এগুলা বলতে পারি না। আমরা কিনে আনি যে দামে তার চেয়ে ১০-২০ টাকা লাভে বিক্রি করে দেই’।

মিরপুর, কারওয়ানবাজার, মৌলভীবাজার, শ্যামবাজার পাইকারি আড়তগুলোতেও একই চিত্র। আগে কিংবা পড়ে যখনই কেনা থাক না কেন দাম বাড়াতে কেউই পিছপা হননি বিক্রেতারা। কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা এক ক্রেতা জানালেন, তিনি দাম দেখে না কিনেই চলে যাচ্ছেন । আরেক ক্রেতা জানালেন, দাম বাড়তে পারে ভেবে ২০ কেজি পেঁয়াজ কেনার চিন্তা করে বাজারে এসেছেন, তবে দাম দেখে এখন ২ কেজি কিনেই চলে যাবেন তিনি। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ আর নতুন কি, আমাদের ভাগ্যই এমন। কোথা থেকে আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিলো আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাজারে দাম বাড়া শুরু হলো’।

খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, রাজধানীর বৃহৎ পাইকারি বাজারগুলোতে আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ যেগুলো ছিল তার দাম বেড়ে হয়েছে ১৬০ থেকে ১৮০ কেজি। এ ছাড়া নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। তবে পুরোনো দেশি পেঁয়াজ পাইকারি বাজারেই বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা কেজি দরে। তবে কেন এক দিনের ব্যবধানে দামের এই উল্লম্ফন তার সদুত্তর দিতে পারেননি কোনো পাইকারি ব্যবসায়ী। শ্যামবাজারের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যখন অন্যরা দাম বাড়িয়েছে তখন তাদেরও বাড়াতে হয়েছে। সবাই দাম বাড়ালে আমার একার কী দোষ বলেন?’ উল্টো প্রশ্ন করেন সেই ব্যবসায়ী। তিনি জানান, পুরো বাজার যে নিয়মে চলছে তারাও সেই নিয়মেই দাম বাড়িয়েছেন। তবে সেই নিয়নমটা কী প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে, আবার সরবরাহ কম থাকলে দাম বাড়বে এটাই নিয়ম।’

বাজারের এমন পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শ্যামবাজার পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, তাদের কথাও কর্ণপাত করেন না ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন ‘এখানে আমাদের কী করার আছে বলেন? সরকার তাদের ধরুক, আমরা চাই না কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর জন্য আমাদের সবাইকে কথা শুনতে হোক।’ তারা সরকারকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করেন কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সবসময় আমরা তা করতে পারি না, আমরা কিছু করলে ব্যবসায়ীরা বলে সে সরকারের দালাল।’ তবে তিনি জানান, গতকাল শনিবার সকালে ম্যাজিস্ট্রেট এসে দোকানদার ১১০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন।

অন্য কোনো বছরই এমন সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ার নজির নেই। শীত শুরু হওয়ায় দেশের যেসব জায়গায় পেঁয়াজের আবাদ হয় সেসব জায়গা থেকে পেঁয়াজ উঠাতে শুরু করেছেন কৃষকরা। অবশ্য আবদুল মাজেদ জানালেন, ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু হবে। তখন দাম অনেকটাই কমে আসবে। এ ঘটনায় ইতিবাচক দিক হিসেবে তিনি উল্লেখ্য করেন। ‘কৃষকরা এবার পেঁয়াজ চাষ করে লাভের মুখ দেখবেন। যেখানে ৩০ টাকা কেজি পেতে কষ্ট হয়, সেখানে আজকে ১০০ টাকা কেজি জমিতেই বিক্রি হচ্ছে, এটা কল্পনাও করতে পারেননি চাষিরা।’ বলেন আবদুল মাজেদ।

পেঁয়াজের হঠাৎ ঝাঁঝ রাজধানী ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, এমনকি উপজেলায়ও। গতকাল শনিবার আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে উঠে এসেছে এমন চিত্র। শুধু দাম বৃদ্ধিই নয়, কোথাও কোথাও পেঁয়াজ হঠাৎ উধাও করে দেয়া হয়েছে বাজার থেকে।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বাজারেও চলছে চরম নৈরাজ্য। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়ছে অতি প্রয়োজনীয় এ পণ্যের। কোথাও কোথাও ২৪ ঘণ্টায় কেজিতে বেড়েছে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। দেশি ও আমদানি করা দুই ধরনের পেঁয়াজের দামই বেড়েছে। শনিবার বেশিরভাগ বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৪০ টাকায়। আগের দিন ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তারপরও বাজারে অনেক জায়গায় দেখা নেই পেঁয়াজের।

ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘটনার জেরে দেশের বাজারে একদিনের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পেঁয়াজের এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ভোক্তারা। তারা বলছেন, ভারত তাদের বাজার ঠিক রাখতে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে; কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রীতিমতো নৈরাজ্য শুরু করেছেন। এক কেজি পেঁয়াজে ১৩০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করার কারণে বাজারে ব্যবসায়ীদের হাতে তেমন পেঁয়াজ নেই। যেহেতু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম, তাই বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। এ জন্য পাইকাররা দেশি পেঁয়াজ মজুদ করে রেখেছেন। শনিবার রিয়াজুদ্দিন বাজারেও ভোরে যে দাম ছিল, সকাল ৯টায় তা কেজিতে ৭০/৮০ টাকা বেড়ে যায়।

পাবনা: পেঁয়াজের এলাকা হিসেবে পরিচিত পাবনায়ও পেঁয়াজের দাম বাড়ছে দফায় দফায়। দাম নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় কয়েকটি বাজারে অভিযান চালিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় দুটি বাজারের ৬ আড়ৎদারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জেলা ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহমুদ হাসান রনি জানান, আমদানি বন্ধ হওয়ায় হঠাৎ করেই বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার দুপুরে পাবনা সদর উপজেলার সিংড়া বাজার ও শহরের বড় বাজারের আড়তে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে দেখা যায়, ১০৫ টাকায় কিনে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ সময় অতিরিক্ত দামে পেঁয়াজ বিক্রির দায়ে ৬ পাইকারি ব্যবসায়ীকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এদিকে অভিযানের খবর পেয়ে বেশকিছু খুচরা ব্যবসায়ী দোকান ফেলে পালিয়ে যায়। পরে সেখানে দাঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া খুচরা ব্যবসায়ীর দোকানে থাকা সব পেঁয়াজ নির্ধারিত দামে বিক্রি করা হয়। পেঁয়াজ কেনা ছিল ১০৫ টাকা কেজি। পরে সেই পেঁয়াজ উপস্থিত ক্রেতাদের মধ্যে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।

মৌলভীবাজার: একই অজুহাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার হাটবাজারেও ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দাম বৃদ্ধি করেছেন। ক্রেতাদের অভিযোগ, কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর, ভানুগাছ, মুন্সীবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে যে পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে তা এক লাভে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় উঠেছে। দোকানে পূর্বের পেঁয়াজ মজুদ থাকার পরও ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন। এসব বিষয়ে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তেমন কোনো তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ করেছেন ক্রেতারা।

শমশেরনগর বাজারের ক্রেতা জাবের আলী, আলমগীর হোসেন, শাহজাহান আহমদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমদানি বন্ধ শুনেই ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, যা মোটেও কাম্য নয়। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম আদায় করে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা। এ বিষয়ে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্রেতারা।

এদিকে, এক দিনের ব্যবধানে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে বাজারে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে সরকারি এই সংস্থা।

গতকাল শনিবার সারা দেশে এই অভিযানে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করা এই সংস্থা।

সন্ধ্যায় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে অধিদপ্তরের ৪টি টিম বাজারে অভিযান পরিচালনা করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহরসহ দেশের ৫৪টি জেলায় একযোগে ৫৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অধিদপ্তরের এ কার্যক্রম আগামীকাল রোববারও সারা দেশে অব্যাহত থাকবে।

আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছে ভারত। এতে দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। গতকাল শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ১৮০-২০০ টাকা ও দেশি পেঁয়াজ ২২০-২৪০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে।