আপডেট : ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ২২:১১
ফিলিস্তিন যে কারণে আমাদের আবেগের জায়গা
সাইফুল ইসলাম

ফিলিস্তিন যে কারণে আমাদের আবেগের জায়গা

৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে। মসজিদ, হাসপাতাল এবং শরণার্থী শিবির বা ত্রাণ বিতরণের লাইন- কোনো কিছুই তাদের নিষ্ঠুর হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিবেক বিবর্জিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্ররা এ হামলাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, এমনকি কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতিও হতে দিচ্ছে না। এবারই প্রথম নয়, ১৯৪৮ সালের পর থেকে থেমে ফিলিস্তিনিদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ইসরায়েলের নির্বিচার গণহত্যা বিশ্ব সম্প্রদায় ও মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পার্থক্য হলো- এবার ফিলিস্তিনের গাজার শাসকদল হামাসের আক্রমণ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সংঘবদ্ধ ও বেশ ক্ষয়ক্ষতিকর থাকায় ইসরায়েলের গণহত্যাও সর্বকালের সব নজির ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশে নির্বিচার ফিলিস্তিনি হত্যা ও ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের জাতিগত শাস্তির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে মানুষের মিছিল। এমনকি ইহুদিরা পর্যন্ত জায়নিস্ট ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আরব এবং ওআইসিভুক্ত দেশগুলো ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এক নিন্দা জানানো ছাড়া। প্রশ্ন হচ্ছে- ফিলিস্তিন কেন আমাদের এত আবেগের জায়গা?

নবী-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত প্রথম কেবলা: ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের আবেগের মূলে রয়েছে সেখানে থাকা মসজিদুল আকসা, যা মুসলিমদের প্রথম কেবলা ছিল। মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়্যতের শুরু থেকে হিজরতের পর ১৬-১৭ মাস পর্যন্ত মুসলিমরা বায়তুল মাকদিস তথা মসজিদে আকসার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করে। পরে আল্লাহ মুসলিমদের কেবলা পরিবর্তন করে দেন। ‘নিশ্চয়ই আমি তোমার আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখাকে লক্ষ্য করেছি। যে কেবলা তুমি পছন্দ কর, আমি তোমাকে সেদিকে ফিরে যেতে আদেশ করছি। তুমি মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফেরাও এবং তোমরা যেখানেই থাকো, ওর দিকে মুখ ফেরাও’ (২:১৪৪)। এ ছাড়া আল্লাহর প্রেরিত অনেক নবী-রাসুলের (আ.) স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন, বিশেষত সোলায়মান, দাউদ এবং মুসা ও ঈসার (আ.) ভূমি ফিলিস্তিন। উল্লেখ্য, আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবাই আমাদের নবী, আমরা তাদের নবী হিসেবে বিশ্বাস ও সম্মান করি। এ কারণেই অন্যরা জানে, মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র ও অবমাননার জবাবে তাদের নবীকে নিয়ে একই কাজ মুসলিমরা করবে না।

ইমামুল আম্বিয়া এবং ইসরা ও মিরাজের ভূমি: মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তার পরে আর কোনো নবী-রাসুল আসবেন না। এটা অন্যান্য আসমানি কিতাবেও বর্ণিত ছিল। আল্লাহতায়ালা মিরাজের রজনীতে মসজিদে আকসায় মুহাম্মদ (সা.)-কে সব নবীর ইমাম বানান এবং ইমামুল আম্বিয়ার মর্যাদা দেন। তার পেছনে সব নবী-রাসুল (আ.) দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। অন্য কোনো নবীর এমন মর্যাদা লাভের সুযোগ হয়নি। মসজিদে আকসায় এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় মসজিদটির মর্যাদা মুসলিমদের কাছে অসীম। এ ছাড়া এটি ইসরা ও মিরাজের পবিত্র ভূমি। ইসরা অর্থ রাতের সফর, আর মিরাজ হচ্ছে ঊর্ধ্বাকাশের ভ্রমণ। নবুয়্যতের ১১তম বছরে ২৬ রজব দিবাগত রাতে আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে তার সান্নিধ্যে নিয়ে যান। এ সফরের বিরতি ছিল মসজিদে আকসায়। আল্লাহ বলেন- ‘পবিত্র ও মহীয়ান তিনি যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত’ (১৭:১)।

পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ: জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মাকদিস পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ। মসজিদ মানে আল্লাহর ঘর। আর আল্লাহর ঘরের মর্যাদা রক্ষা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব। মসজিদে আকসা দ্বিতীয় মসজিদ ও প্রথম কেবলা হওয়ায় মুসলিমদের কাছে এর মর্যাদা অনেক বেশি। আবু যার গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসুল, দুনিয়ায় কোন মসজিদটি প্রথমে নির্মিত হয়েছে? তিনি জবাব দিলেন, মসজিদে হারাম। আমি আবার বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। তারপর আমি প্রশ্ন করলাম, এ দুটির মধ্যে ব্যবধান কত বছরের? জবাবে নবী (সা.) বললেন, ৪০ বছর’ (বুখারী, ৩১১৫)।

তৃতীয় সম্মানিত মসজিদ-শহর: মুসলিমদের নিকট তিনটি শহর সম্মানিত। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে মক্কা মোকাররামা, দ্বিতীয় স্থানে আছে মদিনা মুনাওয়ারা এবং তৃতীয় সম্মানিত শহর জেরুজালেম। সহিহ বুখারী ও মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেন, ইবাদতের উদ্দেশ্যে তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো স্থান ভ্রমণ করা যাবে না। মসজিদে হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদে আকসা। এ ছাড়া সহিহ হাদিসে মসজিদে আকসায় নামাজ আদায়ে ৫০০ গুণ বেশি সওয়াবের কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহর পছন্দনীয় ও বরকতময় ‍ভূখণ্ড: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহুতায়ালা মসজিদে আকসা ও এর আশপাশের অঞ্চলকে বরকতপূর্ণ এলাকা বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মসজিদে আকসা যার চতুর্পাশকে আমি কল্যাণময় করেছি, তাকে আমার নিদর্শনাবলি দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বস্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’(১৭:১)। ইবরাহিম এবং মুসা (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়েও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে কল্যাণ ও বরকতময় বলে উল্লেখ করেছেন আল্লাহতায়ালা। সুরা আম্বিয়ার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘আমি তাকে (ইবরাহিম) ও লুতকে উদ্ধার করে তাদের এমন ভূখণ্ডে (ফিলিস্তিনে) নিয়ে গেলাম, যাকে আমি বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণময় করেছি।’ সুরা আরাফের ১৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘আর আমি দুর্বল করে রাখা লোকদের সেই জমিনের পূর্বের আর পশ্চিমের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিলাম যাতে আমি কল্যাণ নিহিত রেখেছি। এভাবে বনি ইসরাইলের ব্যাপারে তাদের ধৈর্য ধারণের কারণে তোমার প্রতিপালকের কল্যাণময় অঙ্গীকার পূর্ণ হলো আর ফেরাউন ও তার লোকজনের গৌরবময় কাজ ও সুন্দর প্রাসাদগুলো ধ্বংস করে দিলাম।’ সুলায়মান (আ.)-এর ঘটনাসংক্রান্ত কোরআনের বর্ণনা- ‘আমি উদ্দাম বায়ুকে সুলায়মানের জন্য স্বাভাবিক গতিসম্পন্ন করেছিলাম। তার নির্দেশমতো তা প্রবাহিত হতো সে দেশের দিকে যাতে আমি কল্যাণ রেখেছি। আমি প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কেই অবগত ছিলাম’ (২১:৮১)। হাদিসেও শাম তথা ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে বরকত দান করার জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দোয়া করার বর্ণনা এসেছে। মুসনাদে আহমাদে আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে আমার উম্মতের একটি দল। তারা শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো কিছু তাদের পরাজিত করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কেয়ামত পর্যন্ত তারা বহাল থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন তারা কোথায় থাকবে? রাসুল (সা.) বললেন- তারা বায়তুল মাকদিস ও তার আশপাশে থাকবে’ (হাদিস-২১২৮৬)। এ ছাড়া ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনে হাসরের ময়দান হওয়াসংক্রান্ত বিভিন্ন বর্ণনাও হাদিসে এসেছে।

সর্বোপরি, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে অযৌক্তিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইহুদিবাদী দেশটি নারী, শিশু হত্যা, মসজিদ, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরে হামলার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। জোরপূর্বক ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং তাদের জমিতে অবৈধ বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। এমনকি ফিলিস্তিনিদের লোহিত সাগরের তীরে মাত্র ৪১ কিলোমিটারের গাজা ভূখণ্ডে অনেকটা বন্দি করে রেখেছে, যা জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত কারাগার হিসেবে স্বীকৃত। বসতি সম্প্রসারণ বন্ধের জন্য জাতিসংঘ বহু প্রস্তাব পাস করলেও ইসরায়েল সেগুলোর কোনো ধার ধারে না। ১৯৬৭ সালের নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী দুই রাষ্ট্র সমাধানের পথেও নেই ইসরায়েল। তাদের লক্ষ্য জর্ডান-ফিলিস্তিনসহ ভূমধ্য সাগরের তীর পর্যন্ত বৃহৎ ইহুদি রাষ্ট্র গঠন। কখনো প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনো পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ পশ্চিমা শক্তি। এসব কারণে নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে মুসলিম মানসসহ গোটা মানবতাবাদী মানুষের আবেগ ও সমর্থন কাজ করছে। খোদ ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধের দাবির মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আমাদের উচিত প্রকাশ্যে সমর্থন ও দোয়ার মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিজেদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (ইসলামিক স্টাডিজ), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়