লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। একই সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের পাশাপাশি দেশের ভেতরে উৎপাদন করা পণ্যের দামও বাড়ছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংস্থাটি বলছে, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের অন্তত ১৩টি খাতের শ্রমিকরা পরিবারের ন্যূনতম খাদ্যচাহিদা পূরণ করতে পারছে না। ফলে কম খাচ্ছে মানুষ। স্বল্পসময়ে মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ নেই। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুলসংখ্যাক মানুষও এখন কঠিন সংকটে। মূল্যস্ফীতির কারণে মিলছে না আয়-ব্যয়ের হিসাব।
এ জন্য সব খাতে মজুরি বা বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা আছে উল্লেখ করে সংস্থাটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুপারিশও এসেছে তাদের কাছ থেকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সিপিডি কার্যালয়ে সংস্থাটি আয়োজিত ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস এবং বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ : উত্তরণ কোন পথে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডি বলছে, ‘সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঐতিহাসিক (ভয়াবহ) অবস্থায় চলে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আভাস দেখা দিচ্ছে৷ বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, ভবিষ্যতে বিশ্বের ৪২টি দেশে খাদ্যসংকট হতে পারে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়।’
খাদ্যসংকটের আভাস স্পষ্ট। এ জন্য স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার বলে মনে করে সিপিডি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক অস্থিরতায় সব দেশে পণ্যের দাম বাড়লেও, বাংলাদেশে তা তুলনামূলক বেশি। তাদের হিসাবে, দেশে যে আটা ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে- ভারত, পাকিস্তান আর নেপালে তা ৪০ টাকার নিচে। একই অবস্থা মাংসের বাজারেও।
খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুটিই কাছাকাছি অবস্থান করলেও বাজারের চিত্রে দেখা যায়, পণ্যমূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। টিসিবির মূল্য তালিকা ধরে হিসাব করলেও দেখা যায় ২০, ৩০, ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দর বেড়েছে। এ জন্য প্রকৃত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ সময় মূল্যস্ফীতির চাপ বোঝাতে সিপিডি ঢাকা শহরের পরিবারের খাবার কেনার খরচ কত বাড়ছে—এর উদাহরণ দিয়ে একটি হিসাব তুলে ধরেছে।
হিসাবে দেখানো হয়, চলতি অক্টোবরের হিসাবে বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারে ২২ হাজার ৪২১ টাকা খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে। মাছ-মাংস বাদ দিলেও ৯ হাজার ৫৯ টাকা লাগবে। এটাকে ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েট’ বা আপসের খাদ্যতালিকা বলছে সিপিডি। গত পৌনে চার বছরে খাবার কেনায় ওই সব পরিবারের খাবার খরচ ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য একটি রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপণ্য কেনায় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, নিজের মজুত নিশ্চিত না করে কোনো দেশ পণ্য রপ্তানি করতে চাইবে না। তাই ভবিষ্যতে ডলার থাকলেও বিশ্ববাজারে পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্য না-ও থাকতে পারে।
ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি খাতে ন্যূনতম বেতন বাড়ানো অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকার জ্বালানি তেলের দর কমাতে পারে।
মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম
সিপিডি আরও বলছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি, আর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ছে। বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ বাড়লেও সেটা ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম।
সংস্থাটি দেখিয়েছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় বেতন বা মজুরি এত কম হারে বাড়লে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা মাছ-মাংস না খেয়েও সংসার চালাতে পারবেন না। মোট ২১টি খাতের সবশেষ ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে বছরে ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি ধরে, শ্রমিক ও কর্মচারীদের একটি বেতন তালিকা তৈরি করেছে সিপিডি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, হোটেল-রেস্তোরাঁ, প্রসাধনী, দর্জি, বেকারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, প্লাস্টিক, চালকল, চামড়া ও পাদুকা খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির চেয়ে খাবারের খরচ বেশি।
তারা বলছে, ২৯টি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে করহার অনেক বেশি। ১০ থেকে ৯০ শতাংশ কর রয়েছে। এ জন্য এটার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতির ওপর। এটা কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমত। পণ্যের আমদানি খরচও বেশি বলে জানায় সিপিডি। এ জন্য আমদানিতে বিকল্প বাজার দেখার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
খাবারের পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচও অনেক বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তি পকেট থেকে ব্যয় করে বেশি। ব্যক্তিপ্রতি সরকার খরচ করে কম।
জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি
সিপিডির মতে, কিছুদিন আগে মূল্য দিয়ে জ্বালানি পাওয়া গেলেও এখন সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোডশেডিং ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল সব দেশ জ্বালানি আমদানি করে। বাংলাদেশকেও ৯০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হয়। ডলার-সংকটের কারণে আগস্ট থেকে অক্টোবর জ্বালানি আমদানি কমেছে। এ জন্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা গেছে।
সিপিডি বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় ৬০ দিনের জ্বালানি মজুত থাকাকে যথেষ্ট মনে করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে পেট্রোলিয়াম ও ডিজেল ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আমাদের ডিজেল ৬১ দিন, অকটেন ১৯ দশমিক ৬ দিন, পেট্রল ৩৮ দশমিক চার দিন, ফার্নেস ওয়েল ২৭ দশমিক ৯ দিনের মজুত আছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিপিসির হাতে ২৩ হাজার কোটি টাকা আছে। টাকা একদম নেই বিষয়টা তেমন নয়। এ জন্য জ্বালানি তেলের দর পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। জ্বালানি তেলের ঘাটতি মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
রপ্তানি খাতে যেন বিদ্যুৎ জ্বালানির সংকটের প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা রপ্তানির সঙ্গে উৎপাদনশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান জড়িত। পাশাপাশি কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হবে।
রিজার্ভ কমছেই
বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটজনক অবস্থায় নেমেছে। আর যেন না কমে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। রপ্তানির পাশাপাশি বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আইএমএফের হিসাবে এটা প্রকৃত রিজার্ভ নয়। কারণ, এর থেকে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ব্যয় বাবদ বাদ দিতে হবে। এ জন্য আইএফএফ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে যে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে সেগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সরকার।
সিপিডি বলছে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয়ের ভারসাম্য অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন, এক বছর আগেও যা ছিল ৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
সাত সংকট চিহ্নিত
সিপিডি বলছে, ডলার-সংকট, জ্বালানির দর, মূল্যস্ফীতির পারদ, খাদ্য-সংকটের শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিড-১৯- এই সাতটি সংকট বিদ্যমান। চলতি সংকট মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগগুলো সঠিক হলেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এক বছরের মধ্যে পরিত্রাণ পাব- এটা আশা করা যায় না। এজন্য ২০২৩ সালেও এ সংকট থেকে মুক্তি পাব না। সংকট মোকাবিলায় সব স্টেকহোল্ডারদের যুক্ত করতে হবে। সরকারের সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা