আপডেট : ২২ অক্টোবর, ২০২২ ০৯:৩৩
ঋণ-জিডিপির অনুপাত ও বাংলাদেশের অবস্থান
এম এ খালেক

ঋণ-জিডিপির অনুপাত ও বাংলাদেশের অবস্থান

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় চলছে। অর্থনীতিবিদগণ আশঙ্কা করছেন, আগামী দু-এক বছরের মধ্যেই বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হবে। বিশেষ করে আগামীতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ দেশের মূল্যস্ফীতির হার ইতিমধ্যেই অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কোনো কোনো দেশ অতিমাত্রায় ঋণভারে জর্জরিত। অনেক দেশ পণ্য আমদানি ও অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য অতিমাত্রায় বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করছে। ফলে দেশগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে ‘এক্সটার্নাল অ্যাসেট’ মনে করা হয়। কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সংকট থাকলে সেই দেশের সঙ্গে বাইরের দেশগুলো বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না। কারণ তারা মনে করে, সংশ্লিষ্ট দেশটি হয়তো তাদের পেমেন্ট সঠিকভাবে করতে পারবে না।

একটি দেশ শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেই তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকবে এমনটি নয়। সেই অর্জিত অর্থ সঠিকভাবে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। অনেক দেশ আছে যারা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার কারণে মারাত্মক আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে। সার্কের অন্যতম সদস্য, এশিয়ার রাইজিং টাইগার খ্যাত শ্রীলঙ্কা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শ্রীলঙ্কা কয়েক বছর আগে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা সার্কের অনেক দেশের চেয়ে ভালো ছিল। তাদের দেশে শিক্ষিতের হার প্রায় শতভাগ। বিশ্ব অর্থনীতিতেও শ্রীলঙ্কা ক্রমশ স্থান করে নিচ্ছিল। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কা এখন মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক দুঃশাসন এবং উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার কারণে শ্রীলঙ্কা এমন বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশটি ইতিমধ্যেই ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একটি দেশের জন্য ঋণ খেলাপি হওয়া যে কতটা লজ্জার বিষয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। শ্রীলঙ্কা বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ করে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে যার কোনো উপযোগিতা নেই। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা সম্ভাব্য পরিণতি না ভেবেই অর্গানিক চাষাবাদ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা কৃষি খাতে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের পরিবর্তে অর্গানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। ফলে চা থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। এই অবস্থায় দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নিকট থেকে শ্রীলঙ্কা যে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে তার কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। দেশটির ঋণ-জিডিপি অনুপাতও উদ্বেগজনক। ফলে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জনরোষে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

অনেকেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনা করতে চান। এটা তাদের নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ শ্রীলঙ্কার সঙ্কট আর বাংলাদেশের অবস্থা কোনোভাবেই এক পাল্লায় পরিমাপ করা যাবে না। বাংলাদেশ যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার সবগুলোই দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো একটি প্রকল্পও দেখানো যাবে না যা অপ্রয়োজনে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো ঢালাওভাবে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্র থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে তার সবই সহজ শর্তে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে। লন্ডনের দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ঋণ-জিডিপি অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। মালদ্বীপের ঋণ-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটির জিডিপি যদি একশত টাকা হয় তাহলে তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫০ টাকা। ভুটানের ঋণ-জিডিপি অনুপাত হচ্ছে ১২৫ শতাংশের মতো। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এটা ১০০ শতাংশ। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটা ৭৫ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৬০ শতাংশের মতো। নেপালের ক্ষেত্রে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪৫ শতাংশের মতো। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৯ শতাংশ। অবশ্য বাংলাদেশ সরকার বলছে, ঋণ-জিডিপির অনুপাত আরও কম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, কোনো দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৪৯ শতাংশে উন্নীত হলে চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকে। সেই অবস্থায় বাংলাদেশ এখনো স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সঙ্কট মোকাবিলা করছে তা স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। এ জন্য মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিই দায়ী। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে উচ্চ এবং অসহনীয় মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক দেশের চেয়ে কম। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহনে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে প্রতিটি পণ্যের পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ মোট ভোগ্য পণ্যের ২৩ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করে থাকে। ৭৭ শতাংশ পণ্যই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের বিভিন্ন পণ্যের উচ্চমূল্য বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারছে না। তার পরও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়াতে হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২১-২২) বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় অনেকটাই বেড়ে গেছে। আমদানি পণ্য বেশি পরিমাণে আনার কারণে এটা হয়নি। এটা হয়েছে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। আগে একটি পণ্য আমদানি করতে যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন হতো এখন সেই একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে আগের চেয়ে বেশি টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। এ ছাড়া মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের কারণেও আমাদের বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে পণ্য আমদানিকালে। অবশ্য বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও প্রত্যাশা মোতাবেক বেড়েছে। বাংলাদেশ গত অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রথমবারের মতো রপ্তানি আয় করেছে ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ যে খুব একটা বেড়েছে তা নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ স্বল্প পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেও আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ আয় করেছে।

বিশ্বব্যাপী চলতি মৌসুমে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য উৎপাদন হ্রাস যত না ভূমিকা রেখেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করছে পরিবহন ব্যয়বৃদ্ধি। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এ বছর খাদ্যপণ্যের ভালো উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশই তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য নির্বিঘ্নে বিদেশে রপ্তানি করতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই মূলত এ জন্য দায়ী। রাশিয়া-ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্ব খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে। এ বছরও ইউক্রেনে ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তারা সেই খাদ্যপণ্য অনেক দিন বন্দরে জাহাজবোঝাই করে রাখতে বাধ্য হয়। রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাসের জোগান কমিয়ে দিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কারণে খাদ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী মৌসুমে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য উৎপাদন দৃশ্যমানভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই অবস্থায় অনেক দেশেই খাদ্যপণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে। খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য এসব দেশ বেশি বেশি করে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। ফলে ঋণ-জিডিপির রেশিও আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যে সংকট দেখা দিতে পারে। তবে বাংলাদেশ যেহেতু অভ্যন্তীরণ চাহিদাকৃত খাদ্যপণ্যের বেশির ভাগই নিজেরাই উৎপাদন করে, তাই সমস্যা অন্য দেশের মতো ততটা জটিল নাও হতে পারে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।