আপডেট : ২২ অক্টোবর, ২০২২ ১১:৩৮
আবহাওয়ার সঙ্গে বদলাবে গার্ডারের রং
গোলাম মোস্তফা, সিরাজগঞ্জ

আবহাওয়ার সঙ্গে বদলাবে গার্ডারের রং

যমুনা নদীর বুকে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ৩০০ মিটার দূরত্বে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু ঘিরে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে রাত-দিন সমানতালে চলছে পাইলিং ও সুপার স্ট্রাকচার বসানোর কাজ। ছবি: দৈনিক বাংলা

প্রায় আড়াই দশক আগে দেশের উত্তরাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকাসহ বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণের আগ পর্যন্ত সেটিই ছিল দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। সেই সেতু উদ্বোধনের আড়াই দশক পর ফের কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত যমুনা দুই পাড়। ওই সেতুতে রেললাইন থাকলেও ৩০০ মিটার দূরত্বেই তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, যার অবয়ব এখন দেখা দিতে শুরু করেছে যমুনার বুকে। এরই মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে ১০টি পিলার। তাতে দুটি স্প্যান বসানোর কাজও শেষ। দুটি স্প্যানের মধ্যে স্টিলের তৈরি সুপার স্ট্রাকচার বসানোর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু রেলসেতু জানান দিচ্ছে আগমনের।

স্থানীদের আশাবাদ, প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন আরও গতি পাবে।

সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনের এ রেলসেতুর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ৫০টি পিলারের মধ্যে ১০টির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আর নির্মিত পিলারের মধ্যে বসানো হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক স্প্যানও।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের দীর্ঘতম এ রেলসেতু নির্মাণে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে লোহা আর কংক্রিটের সমন্বয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে নতুন কৌশল। এই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে সেতুর কাঠামোতে আলাদাভাবে রং করার প্রয়োজন হবে না। বরং আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলে যাবে গার্ডারের রং। এই প্রক্রিয়ায় সেতুটি বেশ টেকসইও হবে। কারণ, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে আগামী ১০০ বছরেও সেতুর কাঠামোয় কোনো মরিচা পড়বে না।

বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আগে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। আগে আমরা মাত্র ৩৮টি ট্রেন চালাতে পারতাম। এখন এই রেলসেতু চালু হলে ৮৮টি ট্রেন চালাতে পারব। আমাদের দেশের বর্তমান রেলসেতুগুলো এক লাইনের। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রেলসেতু ডাবল লাইনের হওয়ায় একই সঙ্গে একাধিক ট্রেন চলাচল করতে পারবে। সেতু পার হওয়ার জন্য কোনো ট্রেনকে আর অপেক্ষা করতে হবে না। দুই দিক থেকে দুটি ট্রেন একসঙ্গেই চলতে পারবে।’

তানভীরুল ইসলাম জানান, সেতুর ৪৭ ও ৪৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয়েছে প্রথম স্প্যান। আর ৪৫ ও ৪৬ নম্বর পিলারে বসানো হয়েছে দ্বিতীয় স্প্যান। দ্রুতই মধ্যে আরও কয়েকটি স্প্যান বসানো হবে। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে দ্রুত এগিয়ে চলছে এই মেগা প্রকল্পের কাজ।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘১৬ অক্টোবর টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর প্রান্তে দ্বিতীয় স্প্যানটি বসানো হয়েছে। এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। এ দুটি স্প্যানের মধ্যে সুপার স্ট্রাকচার ইরেকশনও (নির্মাণ) সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। এর মধ্যে সেতুর ৪৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি, আমরা মেয়াদের আগেই প্রকল্পটি শেষ করতে পারব।’

সেতুটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সেতুটি চালু হলে যাতায়াতের পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিম জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আসবে। এর ফলে স্বল্প খরচে উত্তরাঞ্চল থেকে ট্রেনে করে সারা দেশে কৃষিপণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। বঙ্গবন্ধু সেতু ও রেলসেতুর পশ্চিমেই গড়ে উঠছে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্পপার্ক। এখানে উত্তর জনপদের সাত লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সেতুটি খুলে দেয়া হলে ট্রেনে করে সেখানের উৎপাদিত পণ্য সহজে দেশ-বিদেশে পরিবহন করা যাবে। এতে আমদানি-রপ্তানি খরচ কমবে। আর বঙ্গবন্ধু সেতু ও মহাসড়কের ওপর চাপও কমবে।

এই সেতুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে নতুন দ্বার উন্মোচন হবে উল্লেখ করে স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না দৈনিক বাংলাকে বলেন, ট্রেনে পরিবহন যেহেতু অনেক সহজ ও তুলনামূলক সাশ্রয়ী, তাই এতে আমাদের উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীরা একটা বড় সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পপার্কসহ নানা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এই জেলাটি যেহেতু তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত, রেলসেতুটি পুরোপুরি চালু হলে একসময় এটি শিল্পনগরীতে পরিণত হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২০ সালের ২৯ নভম্বের বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পরপরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়। তবে ২০০৮ সালে এই সেতুতে ফাটল দেখা দেয়ায় কমিয়ে দেয়া হয় ট্রেনের গতিসীমা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতুর ওপর দিয়ে পারাপার হয়। এতে সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়। সেই সঙ্গে বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা একটি রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।