গণমাধ্যমগুলো ফেসবুকে বেশি ভিউয়ারশিপ পাওয়ার জন্য ছবির সঙ্গে মূল শিরোনাম যোগ করে ফটোকার্ড তৈরি করছে। গণমাধ্যম এটি ভালো কাজে ব্যবহার করছে। তবে এই সহজলভ্য প্রযুক্তি বর্তমানে গুজব নির্মাতাদের প্রিয় একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তারা ফটোকার্ড খুবই সহজে সম্পাদনা করে বহুল প্রচলিত গণমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে চমকপ্রদ সব শিরোনাম দিয়ে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াচ্ছে।
শনিবার দুপুরে খুলনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের মিলনায়তনে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি প্রতিরোধে অংশীজনের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানানো হয়। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন আয়োজক সংস্থা বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহকারী ইফতেখার হোসেন।
তিনি আরও বলেন, গুজব তৈরিতে আরেকটি নতুন প্রযুক্তি খুবই ভয়ঙ্করভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এই ডিপ ফেইক প্রযুক্তির সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র গত ৯ মাসে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনের জের ধরে তিনি বলেন, ডিপফেক ঘিরে সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে রাজনৈতিক বক্তব্যকে বিকৃত করার বিষয়টি। সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ডিপট্রেসের প্রতিবেদনে, রাজনৈতিক কার্যকলাপে এ ধরনের ভিডিওর সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ডিপট্রেস সম্প্রতি অনলাইনে থাকা ১৪ হাজার ৬৯৮টি ভিডিওর সন্ধান পেয়েছে। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ডিপফেক কনটেন্ট বহুজাতিক জনসংখ্যার দেশে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
গুজব প্রতিরোধে তিনটি বিষয়ের ওপর তিনি সবাইকে জোর দিতে অনুরোধ করেন-বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাস্ট্রদূত (অব.) হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, প্রথমত কোনো কিছু দেখামাত্রই শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রযুক্তির সহায়তায় ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ গুজব শনাক্ত করা যায়। দ্বিতীয়ত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, দেশের প্রচলিত আইনে গুজব সৃষ্টিকারী ও গুবজ ছড়িয়ে দেওয়ার সহযোগীদের শাস্তির বিধান রয়েছে। তৃতীয়ত, সামাজিক মূল্যবোধ থেকে গুজবকে না বলতে হবে।
অনুষ্ঠানে গুজব প্রতিরোধে সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মীর আলিফ রেজা। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিককে গুজব প্রতিরোধে সরকার নানা ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত স্কুল-কলেজে সেমিনার করছে। নতুন নতুন আইনও তৈরি হয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে আইন শেখার প্রবণতা খুবই কম। গুজব প্রতিরোধের আইনি বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে পারলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধের সংখ্যা কমে আসবে।
ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে আমাদের সমাজে বেশি গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সুতপা বেতজ্ঞ। তিনি বলেন, সাইদীকে চাঁদে দেখা গেছে এই গুজবের মাধ্যমে আমরা দেখেছি কত মানুষের প্রাণ চলে গেছে। তাণ্ডব চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও এভাবে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেওয়া। দেশে সঠিক গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে পারলে গুজব অনেকাংশে কমে আসবে।
অনুষ্ঠানে খুলনা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসিফ ইকবাল বলেন, অপরাধ ঘটার আগে পুলিশের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ খুবই কম থাকে। তবে আমাদের বিড পুলিশিং নামে একটা কার্যক্রম আছে। তারা জনসম্পৃক্তরা কাজ করে। এখন তারা সাইবার ক্রাইমের ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে কাজ করছে। আমাদের সাইবার পেট্রোলিং নামে আরেকটি ইউনিট আছে। সেই ইউনিটের সদস্যরা প্রতিনিয়ত অনলাইনের ওপর নজরদারী করে। যদিও বর্তমান বিশাল অনলাইন জগতের বিপরীতে সেই কার্যক্রম অনেক সীমিত। তবে দেশের প্রচলিত আইন রয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় গুজব সৃষ্টকারীদের শাস্তির বিধান রয়েছে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, অপরাধ করার পর আইন জানি না বলে মাফ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ জেড এম তৈমুর রহমান বলেন, প্রায় দেখা যায় সুবিধা পাওয়ার জন্য একপক্ষ গুজব ছড়িয়ে দেয়। অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই ইন্টারনেটে সত্য-মিথ্যা যাছাই না করে কোনো কিছু শেয়ার করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।
গুজবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ ন্যায়-বিচার পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন অ্যাড. বাবুল হাওলাদার। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি বিভাগে মাত্র একটি করে সাইবার আদালত রয়েছে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আইনি সহায়তা নিতে শত শত কিলোমিটার দূরের আদালতে আসতে হয়। মামলার পরে তদন্তে প্রচুর বিলম্ব হয়। এভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে গুজবে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়-বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা