‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপারে বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে’ ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেমনে এই কঠিন সত্যটি অমন সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনা করলেন, তা ভেবে পায় না বেলেডাঙার বশির বরকন্দাজ। তার সত্তর বছরের বেশি জীবৎকালে এটা বুঝেছে বশির ‘আমার আরও চাই’; ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’ তার মনের মধ্যে সব সময় এই আক্ষেপ পান-তামাক খেয়ে চরকির মতো ঘোরে। বশিরের ভায়রা ভাই মৌতলার মোতালেব মোল্লার অনেক জমি-জিরাত; বাপের থেকে ভাগ ভালোই পেয়েছে- নিজের কু ও সুবুদ্ধি খাটিয়ে সেই জমির চৌহদ্দী দিন দিন বেড়েই চলছে। আর বেচারা বরকন্দাজ নিজেকে কেমন যেন নাই নাই ভাবের মধ্যে পড়ে আছে। অথচ তার শালী রমিজা, মোতালেবের বৌ, তার স্বামীকে খোটা দেয়- দেখেছ বশির দুলাভাইয়ের পশার কিভাবে বাড়ছে।
সেই হাবিল-কাবিলের কাল থেকে সুখ কারটা বেশি, কারটা কম এই নিয়ে মনের দ্বন্দ্ব থেকেই যাচ্ছে। সুখ দুঃখের দূরত্ব কমাতে যেয়ে অন্ধ হয়ে হাবিল-কাবিলের আত্মহননের সেই যে শুরু- এই শ্যামল-সবুজ বাংলায় এই শান্তির শিবিরে, যে শান্তির শিবির বাঁচাতে বায়ান্ন বছর আগে যারা লড়েছিলেন, তাদের উত্তরসূরিরা কিভাবে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, তা দেখে, শুনে ও জেনে বশিরের মন বেজায় খারাপ। সে যতই তার মন থেকে এসব কুট বুদ্ধি ও নানান চাল চালার ব্যাপার-স্যাপারগুলো সরাতে চায়, ততই যেন তাকে পেয়ে বসে দুশ্চিন্তারা। তার দুশ্চিন্তা আজ শুক্রবারের জন্য না তার দুর্ভাবনা বিহ্বলতা, ভয়, আশঙ্কা, আতঙ্ক শনিবার, রোববার, সোমবারের জন্য। আবার সেই রবীন্দ্রনাথ- ‘সংকটের কল্পনাতে হয়ো না বোহেমিয়ান’। বশিরের মনে পড়ে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে সবাই এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়িয়েছে, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের তৃপ্তি ও আনন্দের মধ্যে তার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার শুরুর বছরগুলোতে আক্রমণ অত্যাচার যে অচলায়তন বেঁধে দিচ্ছিল সে সময় তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের করুণ কাহিনি উঠে এসেছিল; বশিরের বড্ড ভয়, আবার সেই পালিয়ে বেড়ানো, আবারও আত্মপ্রঞ্চনার কালের দিকে এগোচ্ছে তার দেশ। রাজধানী থেকে ৩২৫ কিলোমিটার দূরে এই গণ্ড গ্রামে বশিরের মতো বৃদ্ধপ্রায় ব্যক্তির মনের মর্মযাতনা ও ভয় কেন কাটছে না।
বশির অস্বীকার করতে পারে না- তার দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু উন্নতি হয়নি মানসম্মত শিক্ষার, সুস্বাস্থ্যের, সমঝোতাবোধের, ঐকমত্যের, পারস্পরিক আস্থা বোধের, আয় বৈষম্যের, স্বাধীন মতপ্রকাশের, মানবিক মূল্যবোধের। সুরম্য সদন, ভবন, দপ্তর, অধিদপ্তর, অট্টালিকা বেড়েছে কিন্তু সেখানে ন্যয়-নীতি শুদ্ধ ও সদাচার সাবালকত্ব লাভ করেনি। সেখানে সমান সেবা ও অধিকার লাভের জন্য সবাই পৌঁছাতে পারে না। পাবলিক সার্ভিস বা জনসেবা-পরিষেবা সেখানে গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনতে হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার চাদরে অসংখ্য জোড়াতালি ও ছেঁড়াবেড়ায় বেমানান। সুন্দর সড়ক সেতু ও উডাল সড়কে সবার ওঠার সামর্থ্য নেই। এ সব তৈরি করা হয়েছে অন্যের স্বার্থ উদ্ধার, সম্পদ পাচার ও পরিবহনের দ্বারা বৈষম্য বৃদ্ধির জন্য। মনে হবে এগুলো বানানো হয়েছে উন্নয়নে চোখ ধাঁধানোর জন্য, বিরাট বিরাট ঋণের বোঝা সবার মাথায় চাপিয়ে। সবাইকে ঋণগ্রস্ত করে, বঞ্চিত করে কতিপয়ের আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেওয়া কি সমীচীন? ৫ কোটি টাকা খরচ করে এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অতি আধুনিক করা হয়েছে, কিন্তু সেটি এখন গরু-ছাগলের দখলে বলে মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে (কালবেলা ৫ নভেম্বর-২০২৩)। এই দখলদারিত্বের দোষ-দায় গরু-ছাগলের ওপর চাপানোয় সুন্দরবনের ‘বাঘ, বানর, হরিণ ও কুমির (বাবাহকু)’ সমিতির প্রেসিডিয়াম প্রধান সুন্দর মিয়া গত পরশু বিবৃতি দিয়ে ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ বলে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন বানানোয় তথায় মেশিনপত্তর গোছানোয় এবং মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দলীয় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীকে নিয়োগে সিন্ডিকেট যে ব্যবসা করেছে তারা এখন ‘কোথায় যেন পালাইছে’, উদ্বোধন না হওয়ায় এটি এখন গরু-ছাগলের দখলে। প্রাণীসম্পদ সমিতির সভাপতি বলেন, ‘দখলদারিত্ব তাদের মতো আমাদের ধর্ম ও কর্ম নয়। যারা দখলদারিত্বের পথ বা সুযোগ তৈরি করেছেন, তারাই এর জন্য দায়ী। সুন্দর মিয়া সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন এই প্রথম সুন্দরবনের উন্নয়নের জন্য ২৫০ কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই তহবিল তলাবিহীন ঝুড়িতে রাখা ও বাটোয়ারা করা হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। তিনি বলেন ২০১৬, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২২ সালের বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ের পর পর একই দুর্যোগ কর্তৃপক্ষকে বড় গলায় একই কথা বলতে শুনেছে সবাই উপকূলীয় বাঁধ ও বেষ্টনী নির্মাণ বাবদ ৮ হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা জিন-পরীর মতো আকাশে উড়ছে তো উড়ছে। তারা মাটিতে নামে না। এডিপি বই কিংবা পানি সম্পদের পাতি অফিসগুলো এর কিছুই জানে না। সম্প্রতি সামাজিক মিডিয়ায় এক ঝাঁক সারমেয়র গোলটেবিল টাইপ বৈঠকের ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে তারা কিভাবে সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ করছে। সুন্দর মিয়া আপত্তি তোলেন প্রভুভক্ত ও বিশ্বস্ত সেবার প্রতীক সারমেয় সম্প্রদায়কে এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সত্যের অপলাপের আদলে চরিত্র হনন চলছে। তিনি আরও বলেন যে ‘সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া’র কুটকৌশল থেকে বের না হলে সংকট সৃষ্টিকারীকে তদন্ত করতে বললে সত্য-মিথ্যার বেসাতি হতেই থাকবে। সুন্দর মিয়া মনে করেন সুন্দরবনের সব প্রাণীসম্পদকে এখনো অতটা বোকা ভাবা বা বোকা বানানোর অবকাশ নেই। একসময় তাদের চোখে ধুলা দেয়া যতটা সহজ ছিল, এখন ততটা নেই। সুন্দর মিয়া সুন্দরবন বাসীদের একসময় অনুনয় করে বলতেন, আসুন আমাদের সমস্যার সমাধান আমরাই আলোচনা করে করি। এখানে বাইরের নাক গলাতে দিলে সবারই ক্ষতি। সুন্দরবন ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল ডিমিউজিংয়ের (এসআইপিডি) অধ্যক্ষ সুন্দরিয়া সুপাভানের একটি উক্তি দিয়ে উপসংহার টানেন সুন্দর মিয়া, ‘বাইরের কারও কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তাদের কাছে নিজেদের সম্মান, বিশ্বাস, মর্যাদা ও গৌরবকে বন্দক দিতেই হয়। উভয়পক্ষ যখন একই শক্তির কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভের দেন-দরবার করে, তখন জনমনে আশঙ্কা প্রবল হতেই পারে যে, উভয় পক্ষ তাদের শক্তি, বিশ্বাস ও মান-মর্যাদাকে বন্দক দিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে বন্দক দিতে দিতে একসময় দেখা যাবে, তারা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে।
বশির বরকন্দাজের দুঃখ ও ভয়- দেশের মান-মর্যাদা বিকানোর কাজ আর কত। সবই যদি বিক্রি হয়ে যায়, তাহলে দুর্যোগের দাবানলে তার ঘর-গৃহস্থি সব পুড়ে যাবে। সত্য ও মিথ্যার, পক্ষ ও বিপক্ষের, স্বপ্নের ও সত্যের মধ্যকার ব্যবধান যত দ্রুত ঘুচবে, ততই মঙ্গল সবার জন্য। ব্যবধান আর না বাড়ুক, ব্যবধান কমে আসুক সমঝোতায়, সমানুভূতি ও দায়িত্বশীলতায়। বশির ক্রিকেট খেলা না বুঝলেও শুধু তার দেশের সঙ্গে যখন অন্যদেশের খেলা চলে, তখন সে দারুণ ভক্ত হয়ে ওঠে ক্রিকেটের। কেননা এর সঙ্গে তার দেশের মান-মর্যাদা বাড়া-কমার ব্যাপার জড়িত যে। এবারের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার ব্যবধানটা বড্ড বেশি মনে হয় বশিরের কাছে। বাংলাদেশ টিমের জ্যেষ্ঠ, দক্ষ ও করিৎকর্মা ক্রিকেটারকে বাদ দেয়ার নাটক দেখে বশির ভীষণ চোট পেয়েছে। করিৎকর্মা ক্রিকেটাররা যখন ছক্কা মারেন কিংবা বিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরত পাঠান, তখন বশিরের মনে হয় বাংলাদেশ ছক্কা মেরেছে বাংলদেশ ব্যাট খেয়ে ফেলছে। বশিরের এলাকার কাট মাস্টার তার কারিশমা আর দেখাতে পারেনি বলে তাকে সেদিন দল থেকে সরানো হয়েছে। অধিনায়কের নৈতিক ও ব্যবসায়িক বিপর্যয় তার দলের নৈতিক মনোবল ভেঙে গেছে- বিশ্বস্ত টিম মেটকে সরানো সম্পর্কে তার মন্তব্যের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ শুঁকেছে সবাই। এটা দুঃখজনক শুধু তার জন্য নয়, গোটা দেশের জন্য।
বশির নিজেকে কোনোভাবেই সবজান্তা ভাবতে চায় না, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা মনোভাব ভঙ্গি প্রকাশের ব্যাপারে নানান সীমাবদ্ধতাকে সে ভয় পায়। এই অজপাড়া গাঁয়ে সে যখন তার পরিবার, সমাজ ও সংসার নিয়ে যখন ভাবে, তখন মহানগরের বড় কর্তারা ‘যেখানে দেখিবে ছাই- উড়াইয়া দেখ তাই- পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’- দর্শনে ‘উন্নয়ন’ দেখানোর মাধ্যমে গোটা দেশকে সম্মোহিত করতে চায়। প্রগলভ ও প্রচারে ভরা এই উন্নয়নই কারও কারও স্বছতা ও সুশাসন বর্জিত উপার্জনের উৎস। উন্নয়নই বৈষম্য বৃদ্ধির হাতিয়ার- উন্নয়নই শোষণ-বঞ্চনার বাহ্যিক ব্যবধান বাড়ছে সবখানে- সব প্রাণে- সব আচার-আচরণে। ইতিবাচক চশমায় ধুলা জমে জমে তা নেতিবাচক হয়ে উঠছে। ইতিবাচক ও নেতিবাচকতার মধ্যকার ব্যবধানে বশিরের চোখে ছানি পড়ার উপক্রম। উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালে দরকারি মেশিন বসানোর লোভ দেখানো হচ্ছে। বশিরের চোখের ছানি তার রেটিনাকে খতম করা পর্যন্ত যেন না পিছায় এই প্রতিশ্রুতি পূরণ।
লেখক: সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা