আপডেট : ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ১৩:৫৬
অস্থিরতা সৃষ্টির নানা ইস্যু, যদি লাইগা যায়  
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

অস্থিরতা সৃষ্টির নানা ইস্যু, যদি লাইগা যায়  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের ক্ষমতায় যাওয়া রাজনীতি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এক পক্ষ এক দফার আন্দোলন তথা সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন কমিশন বাদ দেওয়া এবং নতুনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি নিয়ে এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছিল। মূলত বিএনপির নেতৃত্বে দুই-তিন ডজন নামসর্বস্ব দল নিজেদের যুগপৎ আন্দোলনকারী শক্তি হিসেবে দাবি করত। তবে এদের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী অঘোষিতভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এমনকি ১০ দফা দাবি যখন জাতির সম্মুখে বিএনপি উপস্থাপন করে তখন জামায়াতও ১০ দফা দাবি উত্থাপন করে। তবে জামায়াত এবং বিএনপি কৌশলে আন্দোলনে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে যুগপৎ আন্দোলনকারী পরিচয়ে একসঙ্গে রেখে আন্দোলন করেছিল। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে পদযাত্রা, মিছিল, সমাবেশ, মহাসমাবেশ ইত্যাদির পর ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশটিকে মহাযাত্রা হিসেবে অভিহিতও করা হয়েছিল। ওইদিনের মহাসমাবেশে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত শিবিরও আলাদাভাবে মতিঝিল এলাকায় জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেদিনের যুগপৎ আন্দোলনকারী এবং জামায়াতের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত জনসভাটি শান্তিপূর্ণ থাকেনি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলোর কর্মসূচি সেদিন সহিংস হয়ে উঠেছিল। ফলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ব্যবহার করায় মহাসমাবেশ ভেঙে যায়। এরপর যুগপৎ আন্দোলনকারী সব রাজনৈতিক দল হরতাল-অবরোধ, নির্বাচন বর্জন প্রত্যাখ্যান প্রতিরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি টানা দুই মাস চালিয়ে যায়। যদিও এবারের হরতাল-অবরোধ মোটেও আন্দোলনকারীরা জমাতে পারেননি, যেমনটি ২০১৪-১৫ সালে করা সম্ভব হয়েছিল। ভাঙচুর, গাড়ি পোড়াপুড়ি রেলে অগ্নিসংসযোগ এবং যাত্রীসাধারণ পুড়িয়ে মারার কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটানো ছাড়া আন্দোলন খুব একটা জমাতে যেমন পারেনি, নির্বাচনও ঠেকাতে পারেনি। ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, প্রতিহত করতে চেয়েছিল এবং জনগণকে এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছিল। তাদের এই আহ্বানে ভোটারদের বড় অংশ সাড়া দেয়নি। ফলে নির্বাচন সহিংসতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনাবাহিনী কেন্দ্রসমূহে ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান করেছিল। নির্বাচনবিরোধীদের উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টিসহ আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় সে জন্য আওয়ামী লীগ নিজদলীয় প্রার্থী ছাড়াও অন্যদের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার অনুমতি দেয়। ফলে নির্বাচনটি বিরোধী দলের প্রত্যাখ্যানের মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। বিরোধী দল মনে করেছিল যে তারা অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে যা বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু তাদের সেই হিসাব ভুল প্রমাণিত হলো। নির্বাচন বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও সুষ্ঠু হয়েছিল বলে অভিমত প্রকাশ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১১ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠিত হয়। এরই মধ্যে সব দেশের সরকার নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি জানিয়েছে। সুতরাং বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিতর্কিত এবং বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। এরপর বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন শুরু করার কথা বললেও সেটি আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার নানা গোষ্ঠীর তৎপরতা একের পর এক সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করার নজির দেখা গেছে। নতুন সরকার শপথ নেওয়ার সময় থেকেই দেশে ধান-চালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমন ফসলের ভরা মৌসুমে চালের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ শুধু ভোক্তারা নয়- ব্যবসায়ীদেরও অনেকে বুঝে উঠতে পারছেন না। চালের বাজার অস্থিতিশীল করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার কোনো হীন কৌশল কোনো কোনো মহলের লুকিয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর সরকারের বিরুদ্ধে আকস্মিকভাবে কিছু ঘটানোর উদাহরণ রয়েছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার ১ মাস ১৯ দিন পর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরদের আকস্মিকভাবে বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করার ঘটনাটি ছিল দেশে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করা এবং নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার হিসাবনিকাশও পরিকল্পনাকারীদের ছিল বলে বিভিন্ন মহল থেকে পরবর্তী সময়ে ধারণা করা হয়েছে। পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহটিকে আমাদের জাতির ইতিহাসে বড় ধরনের বিয়োগান্ত ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা যায়। সেই সময় সরকার অত্যন্ত ধৈর্যর সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। সেনাবাহিনীও সেই সময় কারও কোনো ফাঁদে পা দেয়নি। কিন্তু যারা নেপথ্যে এই ঘটনা এবং ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতিকে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন মহল তখন বুঝতে পেরেছিল। সুতরাং একটি নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশে ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো কিছু একটা চেষ্টা করে থাকে যা ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং পরবর্তী কয়েক দিন দেশে দেখা গেছে।

এবারও ষড়যন্ত্রের খেলা থেমে নেই। সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার নানা ঘটনা একের পর এক ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ’৮০-এর দশকে ক্রীড়া উন্নয়ন তহবিল গঠনের জন্য লটারি প্রতিযোগিতার টিকিট বিক্রয়ের একটি বিজ্ঞাপন সারা দেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে ‘যদি লাইগা যায়’ কথাটি লটারির টিকিট ক্রয়ে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছিল, একইভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবাদ বাক্যের মতো ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরাও নানা ইস্যু সম্মুখে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। মানুষকে উত্তেজিত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। সেখানেই যদি মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে মাঠে নেমে পড়ে তাহলেই দীর্ঘ আন্দোলন করে যা সফল করা যায়নি, তা যদি বক মারার মতো আকস্মিকভাবে ঘটানো যায় তাহলে তো কথাই নেই। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে; কিন্তু বাজারই একমাত্র মনোযোগের বিষয় নয়। এর বাইরেও যে তাদের অনেক বিষয় রয়ে গেছে সেটি অনেকে হয়তো বুঝে ওঠার আগেই দেশে যদি কিছু একটা ঘটে যায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একটি মহল ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করার জন্য নানা ধরনের বিষয়-আসয়কে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। তবে সরাসরি ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মাঠে না নেমে মহলটি দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই নয়, ধর্মীয়ভাবেও উত্তেজিত করার মতো কৌশল অবলম্বন করেছে বলে মনে হয়। ‘জাতীয় শিক্ষক ফোরাম’ নামক কোনো শিক্ষক সংগঠনের নাম সরকারি খাতায় আছে কি না জানি না। কিন্তু আমাদের দেশে যে কেউই একটা নাম ব্যবহার করে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করতে কোনো বাধা নেই। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক সেমিনারে। জাতীয় শিক্ষক ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক নাছির উদ্দীন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সেক্রেটারি জেনারেল প্রভাষক আবদুস সবুর। প্রধান অতিথি ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর চরমোনাই। প্রধান অতিথি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণ নেই। ৭ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে জনগণ সরকারকে লালকার্ড দেখিয়েছে।’ বিশেষ অতিথি ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চরমোনাই কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী। আরও যারা বক্তৃতা করেছেন তারা হলেন- বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ইয়াকুব হোসেন, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম, লেখক গবেষক ও কলামিস্ট মুসা আল হাফিজ, শিক্ষক ও গবেষক ড. সরোয়ার হোসেন, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান সাংবাদিক নেতা মুন্সী আবদুল মান্নান, প্রিন্স ফাহাদ বিশ্ববিদ্যালয় সৌদি আরবের সহকারী অধ্যাপক ড. হাফেজ মাবরুক বিল্লাহ, মাহমুদুল হাসান রায়হান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মোস্তফা মনজু, মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবুল কাশেম, জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা এ বি এম জাকারিয়া, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি নুরুল বশর আজিজী, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির। সেই অনুষ্ঠানেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীবিষয়ক অধ্যায়ে শরীফার গল্প থাকা দুটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলার আহ্বান জানান এবং নিজেও এই পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলেন। অথচ এই গল্পের কোথাও ধর্মীয় কোনো বিতর্ক নেই। কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো বক্তব্যও নেই। আমাদের সমাজে নারী, পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বসবাস কারও অজানা নয়, নতুনও নয়। কিন্তু কুসংস্কারের কারণে অনেকেই তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া সন্তানদের স্বাভাবিকভাবে আদর-স্নেহ দিয়ে পরিবারে বসবাসের ব্যবস্থা করেন না। সে রকমই একজন হিজড়া তার জীবনের গল্প সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সম্মুখে বর্ণনা করেছেন। মানুষের শারীরিক গঠন ও বৈচিত্র্যকে বোঝার বিষয়টি এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি মানুষই এই বৈচিত্র্যকে ধারণ করে সমাজে থাকার অধিকার রাখে। এখানে কাউকে অচ্ছুত, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিষয়টি যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গঠিত না হতে পারে সেই শিক্ষাই এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু যারা মানুষের শারীরিক গঠন, মানসিক সমস্যার বৈজ্ঞানিক কারণ জানেন না তারা অনেক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে থাকেন। এই গল্পে শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার কাহিনিটি মোটেও বানোয়াট নয়। কিন্তু শারীরিক এই পরিবর্তনের কারণ যাদের জানা নেই তারাই গোটা মানুষটাকেই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এগুলো যেন না ঘটে সেই শিক্ষাই গল্পে দেওয়া আছে। আসিফ মাহতাব নিজেকে দার্শনিক বলে দাবি করেছেন; কিন্তু তিনি যে কাজটি ওই সেমিনারে করেছেন সেটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর সঙ্গে শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শনের কোনো শিক্ষাই কার্যকর হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আসিফ মাহতাবের বই ছেঁড়ার এবং তার বর্ণিত বক্তব্য তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দেশে উন্মাদনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ তার আসিফ যদি কোনো দ্বিমত এই গল্প নিয়ে থেকে থাকে তাহলে তিনি এনসিটিভি কর্তৃপক্ষের নিকট লিখতে পারতেন, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন বা পত্রপত্রিকায় লিখতে পারতেন। একজন শিক্ষক শিক্ষাকে যুক্তিজ্ঞান এবং প্রায়োগিক বাস্তবতা দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু এখানে আয়োজনটিই ঘটেছিল উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এবং সেই সিদ্ধিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যারা বইটি পড়বেন তারা যে ধারণা পাবেন তার সঙ্গে আসিফ মাহতাবের কিংবা যারা ওইদিন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা রকম কথা বলেছেন তাদের বক্তব্যের কোনো মিলই খুঁজে পাবেন না। শিক্ষাক্রম একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়। সেটিকে কুসংস্কারের বিশ্বাস দিয়ে কখনো বোঝা যায় না, সম্ভবও নয়। যতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হোক না কেন, উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হওয়ার নয়। তবে শিক্ষক, অভিভাবক এবং সচেতন সব মহল এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার-প্রচারণার বিপক্ষে জ্ঞানবিজ্ঞান, যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমকে বোঝার চেষ্টা করলে আমাদের নতুন প্রজন্ম সত্যিকার জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক