ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তাধীন অবস্থায় কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম নিয়োগকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ। পূর্ব ঘোষিত আজকের নিয়োগবোর্ড স্থগিত করার পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী দ্বারা শিক্ষকদের অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া, অস্থায়ী কর্মচারী দ্বারা ভিসি ও শিক্ষক অপদস্তের মতো ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে ক্যাম্পাসজুড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কার্যালয়, মেইন গেট, প্রশাসন ভবন ও ভিসির বাস ভবনের সামনে এসব ঘটনা ঘটে। এতে পক্ষে-বিপক্ষে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য তুলে ধরেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা।
এই দিন সকালে নিয়োগ বোর্ড আপাতত স্থগিত রাখার দাবি জানাতে উপাচার্যের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। তাদের কথোপকথনের একপর্যায়ে হুড়মুড়িয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করে ইবিতে দীর্ঘদিন বিভিন্ন দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মরত সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা ও কর্মকর্তা সমিতির সদস্যরা। তারা একপর্যায়ে ভিসির বিপক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। একই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে ভিসির নির্দেশেই পরবর্তীতে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। উপস্থিত শিক্ষকদের গালাগাল ও লাঞ্ছিত করে থাকেন তারা। তুমুল হট্টগোলের একপর্যায়ে অপদস্ত হয়ে, গালাগাল ও লাঞ্ছিতের প্রতিবাদে শাপলা ফোরাম, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শিক্ষক সমিতির শিক্ষকরা কার্যালয় থেকে বেরিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের সামনে মানববন্ধনে অংশ নেন।
মানববন্ধনে ইউজিসির তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ বন্ধ রাখা, বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত অন্যান্য নিয়োগ বন্ধ রাখা, প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বিশেষজ্ঞ সদস্য নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত সব শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রাখা। এ ছাড়া প্রচারিত সব দুর্নীতির তদন্ত দ্রুত সময় শেষ করাসহ নানা দাবি তুলে ধরেন শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা (যারা ইতোমধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে) দীর্ঘদিন ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি, সঠিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা যদি যোগ্য হিসেবে প্রতীয়মান হন, প্রশাসনের যদি মনে হয় যে তারা যোগ্য, তবে তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতে চান। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ-বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো বিষয় আছে বলে আমার মনে হয় না।
ঘটনাস্থলে থাকা প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘নিচে মাইকে এক পক্ষ এক ধরনের বক্তব্য, কর্মকাণ্ড করছিল। একপর্যায়ে ওখান থেকে একটা টিম ভিসি অফিসে দাবি নিয়ে আসে। বিষয়টা হচ্ছে মানুষের দাবি-দাওয়া থাকতে পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা চাই যে কেউ অফিসে ঢোকার আগে পিএসের সঙ্গে কথা বলে বা অনুমতি নিয়ে ঢুকুক; কিন্তু পর্যায়ক্রমে না ঢুকে প্রথমে কর্মচারী-কর্মকর্তা, এরই মধ্যে আদর্শিক শিক্ষক গ্রুপ, পরক্ষণেই ছাত্রলীগ ঢুকে পড়ে। আমি জানি না পিএসের সঙ্গে অনুমতি নিয়েছে কি না। একটু ডেকোরামের মাধ্যমে একটা গ্রুপ শেষ হলে অন্য গ্রুপ আসবে, এভাবে তো শৃঙ্খলা থাকে। আমার প্রথম পরিচয় শিক্ষক, দ্বিতীয়ত আমি দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সবার প্রতি এটাই অনুরোধ থাকবে।’
ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শেলিনা নাসরীন বলেন, যেহেতু নিয়োগ নিয়ে একটি বিষয় তদন্তাধীন রয়েছে, তাই আমরা বলেছিলাম যে তদন্ত প্রতিবেদন ইতিবাচক না হওয়া পর্যন্ত আপনি নিয়োগে যাবেন না। আর যদি নিয়োগে আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হন বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক নিয়োগের মতো ভালো একটি কাজ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। এই সামান্য কথাটি আমরা বলা শেষ করতে পারিনি; কিন্তু অনেক সন্তানসমতুল্য শিক্ষার্থী, অছাত্র বা বহিরাগতদের আমাদের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে দাঁড় করানো হয়েছে। আমাদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমরা বিভিন্ন পদ-পদবিতে থাকলেও নিয়ম মেনে সেখানে যাই, কিন্তু এরকম একটা মিছিল কীভাবে সেখানে প্রবেশ করল, কারা নেতৃত্বে ছিল, কারা তাদের সাপোর্ট দিয়েছে, তা বের করা প্রয়োজন।’
শিক্ষক ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, ‘ইমামের মতো একটি পদ নিয়ে এমন হচ্ছে, এটি অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। আমি নিজেই এখানে শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি ছিলাম। আমি দেখেছি, এখানে যারা এসেছে তাদের অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। তারা আমাদের এখানে উপস্থিত সম্মানিত শিক্ষকদের সম্মানহানি করেছে।’
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। কয়েকজন মুষ্টিমেয় শিক্ষক যারা নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এমন কয়েকজন কুচক্রী মিলে একটা নিয়োগ বোর্ড ছিল তারা সেটা বন্ধ করতে গিয়েছিল। যা একটি গর্হিত এবং রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব এ বিষয়গুলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করতে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছি।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও এমন হয়ে থাকে যে একেকজনের নাম বিকৃতি করে চাকরি দিয়ে দিচ্ছে বা চাকরির প্রলোভনে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। যেখানে এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে আমার কোনো কনভারসেশনই নেই, সেখানে ওই চ্যাট বা কল রেকর্ড আমার কি না এর তো কোনো প্রশ্নই আসে না।’
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ বোর্ড স্থগিত হবে কি না জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি এরকম কল রেকর্ড বা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ বোর্ড বাতিল হয় তবে তো বাংলাদেশে কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে আমি আমার বোর্ড মেম্বারের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব। আমার শিক্ষকরা যে আজকে এখানে আসবেন এটাও পূর্বনির্ধারিত ছিল না। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ছাত্ররা এখানে প্রবেশ করে। আমি জানিও না তারা কারা, তাদের প্রবেশটা সম্পূর্ণই অপ্রত্যাশিত ছিল।’
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নিয়ম মেনে যথাসময়ে নিয়োগ বোর্ডে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার একপর্যায়ে তাদের বের করে দেন কর্মকর্তা সমিতির নেতারা। তবে পরবর্তীতে আবার পরীক্ষা শুরু হয়ে সাতজনকে ভাইভার জন্য নির্বাচিত করা হয়।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা