আপডেট : ২৬ অক্টোবর, ২০২২ ১৮:২৯
ঘুমের রাজ্যে স্বপ্ন গদ্যময়
শুভ সালাউদ্দিন

ঘুমের রাজ্যে স্বপ্ন গদ্যময়

লাল গ্রহটার ওপরে পা রাখলেন। চারপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এটা মঙ্গল গ্রহ। চারপাশে সুনসান নীরবতা। আপনার বুঝতে কষ্ট হলো না একাই আছেন এই গ্রহে। সামনে এগিয়ে চলেছে, আর বদলাতে শুরু করেছে গ্রহের পরিবেশ। তখন আপনার মনে হলো এটা মঙ্গল গ্রহ নয়। গ্রহটার এক অংশ পাকা টমেটোর মতো টকটকে লাল, আরেক অংশ মেঘমুক্ত আকাশের মতো নীল। হঠাৎ কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে শুরু করল, চেনা পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। হঠাৎ তখন আপনার মনে হলো মঙ্গল নয়, পৃথিবীতেই আছেন। আষাঢ়ে গল্প মনে হতে পারে, বাস্তবে এমনটা ঘটে না। তবে স্বপ্নে এসব অহরহ ঘটতে দেখা যায়।

কিন্তু ঘুম জিনিসটা আসলে কী?

ঘুমের একটা বিশেষ সময়ে আমরা স্বপ্ন দেখি। ঘুমের চারটি ধাপ আছে। ধাপগুলোকে আলাদা করা হয় চারটি ব্রেইনওয়েভে।

ঘুমের বিশেষ একটা পর্যায় হলো রেম বা র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট। এ সময় মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায়। বাড়ে রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দনও। এ সময় চোখ দ্রুত নড়তে থাকে। এ জন্যই এর এমন নাম।

রেমেরও আবার শ্রেণিবিভাগ আছে। কজন মানুষের ঘুম ঘুম ভাব প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু চারপাশের শব্দ মৃদুভাবে তখনো কানে যাচ্ছে। এ সময়কে বলে নন রেম স্লিপ। এর পরেই নন রেম ১; ঘুম ঘুম ভাব, প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে এমন একটা অবস্থা। এই ধাপে মানুষ গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, একটু জোরে শব্দ শুনলে দ্রুত জেগে উঠতে পারে। এই ধাপ পাঁচ থেকে দশ মিনিট স্থায়ী হয়।

এরপর ঘুম আরেকটু গভীর হলে নন রেম-২ ধাপে প্রবেশ করে। চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে অচেতন হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। পেশি শিথিল হয়, শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং গভীর ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নেয় । এটির স্থায়ীত্বকাল দশ থেকে পঁচিশ মিনিট।

এরপরের ধাপ হলো নন রেম-৩। এটি ঘুমের সবচেয়ে গভীর ধাপ। এই ধাপ থেকে কাউকে জাগিয়ে তোলা কঠিন। হৃৎস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস যথাসম্ভব সর্বনিম্নতে চলে যায়, পেশিগুলো পুরোপুরি শিথিল হয়ে যায়। এই ধাপ স্থায়ী হয় বিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। কেউ যদি সঠিকভাবে রেম-৩ ধাপ সম্পন্ন করে, তাহলে ঘুম থেকে উঠে সতেজ অনুভব করবে।

এরপরই আসে ঘুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ- রেম। এই ধাপেই মানুষ ভালোভাবে স্বপ্ন দেখে। এই ধাপে মস্তিষ্কের কার্যক্রম জাগ্রত অবস্থার মস্তিষ্কের মতোই হয়। এই সময়ে নরএপিনেফ্রিন, সেরাটোনিন, হিস্টামিন নামের হরমোনগুলোর নিঃসরণ বন্ধ থাকে। তাই পেশিগুলোর অবস্থা হয় অনেকটা প্যারালাইজড রোগীর মতো। এ সময় দৌড়ানোর স্বপ্ন দেখলে তাই বিপত্তি ঘটে। পেশি কাজ করে না বলে আমরা সত্যিকার অর্থে দৌড়াতে পারি না স্বপ্নে। যাদের এই হরমোনগুলোর নিঃসরণ বন্ধ হয় না, তাদের পেশিগুলো সচল থাকে। এ সময় যদি কেউ স্বপ্নের মধ্যে দৌড়ানোর বা হাঁটার স্বপ্ন দেখে, তাহলে সে সত্যি-সত্যিই হাঁটে বা দৌড়ায়। অনেকের ঘুমের মধ্যে হাঁটার রোগ আছে, সেটা এ কারণেই হয়।

এলেবেলে স্মৃতিগুলো গুছিয়ে সুশৃঙ্খল করা, শিখনপদ্ধতি রপ্ত, সৃজনশীলতার জন্যও ঘুমের এই ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। ফিনল্যান্ডের হেলসিনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক টারজা পোরখা ও তার দল একটি গবেষণা চালান। তারা আবিষ্কার করেন, রেম ঘুমের ঘাটতি হলে মানুষের স্মৃতিশক্তি ভীষণরকম দুর্বল হয়ে যায়। কমে যায় জটিল চিন্তাভাবনা এবং ধাঁধা সমাধান করার ক্ষমতাও।

২.

ঘুমের এই ধাপগুলো নব্বই মিনিট পর পর চক্রাকারে চলতে থাকে। একজন মানুষ গড়ে তিন থেকে পাঁচটি স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে বিশ-ত্রিশ মিনিট দীর্ঘ হতে পারে। স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কের যুক্তি এবং জটিল চিন্তাভাবনার কার্যক্রম অনেক কম থাকে, আর আবেগজনিত ভাবনা কার্যক্রম বেশি থাকে। তাই আমরা স্বপ্নে উড়তে পারি। কিন্তু ওড়ার ক্ষমতা কোথায় পেলাম- এ ধরনের যৌক্তিক ভাবনা কাজ না করে না বলে ওড়াটাকে উপভোগ করা যায়।

স্বপ্ন দেখার উদ্দেশ্য, কারণ এবং কাজ সম্পর্কে আমরা এখনো সঠিকভাবে জানি না। এটা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হাইপোথিসিস প্রচলিত আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক অ্যালান হবসন ও রবার্ট ম্যাককার্লির মতে, ঘুমের সময় মস্তিষ্কের প্রধান কাজ স্মৃতিকে সংরক্ষণ ও সুশৃঙ্খল করা। এ সময় উপজাত হিসেবে স্বপ্নের সৃষ্টি হয়।

ঘুমের মধ্যে আমাদের অবচেতন মস্তিষ্ক সারা দিনের অর্জিত স্মৃতিগুলোকে সাজানো-গোছানোর কাজ করে। এর মধ্যে যেগুলো প্রয়োজনীয় সেগুলোর সংরক্ষণ ও একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ তৈরি করে। অপ্রয়োজনীয়গুলো ঝেড়ে ফেলে দেয়। মস্তিষ্কে কর্টেক্স নামে একটা অংশ থাকে। এই অংশ এই স্মৃতি সংরক্ষণের কাজটা করে। অনেক সময় কর্টেক্স স্মৃতির ভাণ্ডারে থাকা সব তথ্য ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। সেগুলোকে অর্থবোধক করার জন্য সব স্মৃতি এক করে সিনেমার রিপ্লের মতো চালিয়ে দেয়, সেটাই আসল ব্যাপার।

৩.

ফিনল্যান্ডের টুর্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এন্টি রিভনসুর একটা ব্যাখ্যা আছে। সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির সিমুলেশন তৈরি করে তা থেকে সচেতন করা স্বপ্নের প্রধান কাজ। তিনি এটা মনে করেন, তার কারণ হলো বেশির ভাগ স্বপ্নই নেতিবাচক। বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শিকারযুগে মানুষ পশুপাখি শিকার করে জীবনযাপন করত। তখন জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীরাই ছিল মানুষের প্রধান শত্রু। এদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবসময় সচেতন থাকতে হতো। যারা নেতিবাচক স্বপ্ন বেশি দেখত, তারা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে বেশি প্রস্তুতি নিয়ে রাখত। টিকে থাকার লড়াইয়ে এই ব্যাপারটা মানুষকে এগিয়ে রাখে সে সময়। এই ব্যাপারগুলো জিনবাহিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকেই সচেতন করে দিত।

এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ ডন সাইমস, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম ডেমেন্ট, বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড স্বপ্ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গবেষণা করেছেন। বহু গবেষণা এখনো চলমান। ভভিষ্যতে হয়তো আমরা স্বপ্নের রহস্যের পর্দা পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে পারব।

৪.

মানুষ ছাড়াও গরু, ছাগল, ঘোড়া, কুকুরসহ বিভিন্ন চতুষ্পদী প্রাণী, এমনকি কিছু পাখিও স্বপ্ন দেখে। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্ট্যানলি কোরেন মনে করেন, কুকুর আমাদের মতোই স্বপ্ন দেখে। পার্থক্য হলো তারা আমাদের চেয়ে দ্রুত রেম ধাপে প্রবেশ করে। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে কুকুর রেম ধাপে পৌঁছে যায়। তবে এদের স্বপ্নের উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি।

স্বপ্ন যে সবসময় ছবিনির্ভর হতে হবে তাও নয়। এটি শব্দ বা স্পর্শের অনুভূতি-নির্ভরও হতে পারে। জন্মগতভাবে অন্ধরাও স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্ন শব্দ এবং স্পর্শনির্ভর হয়। তাদের দুঃস্বপ্নের ধরন হলো এমন- কোথাও হারিয়ে গেছে, রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না, গাড়ি এসে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। তবে সবগুলোই দর্শন আর শব্দের অনুভূতি, আমাদের মতো ভিজ্যুয়াল অনুভূতি হয় না তাদের।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান