আপডেট : ২৭ অক্টোবর, ২০২২ ১৪:৪৩
কবিরাজির নামে প্রতারণা-খুন, ১৭ বছর পর গ্রেপ্তার
প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা

কবিরাজির নামে প্রতারণা-খুন, ১৭ বছর পর গ্রেপ্তার

বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু বেগম হত্যার আসামি হেমায়েত খান ওরফে জাহিদ কবিরাজকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

পঞ্চাশোর্ধ্ব হেমায়েতের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ ভারতেও কবিরাজির নামে বছরের পর বছর প্রতারণা করেছেন। প্রতারণার পাশাপাশি খুন করেছেন মানুষও। ২০০৫ সালে বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামিকে গতকাল বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাট জেলা সদর এলাকায় মনু বেগম এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় হেমায়েতসহ পাঁচজনকে আসামি করে ভুক্তভোগীর বোন বাদী হয়ে ওই বছরের ৯ অক্টোবর বাগেরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর থেকেই মামলার অন্যতম আসামি হেমায়েত পলাতক ছিল। মামলাটির তদন্ত শেষে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে আদালত হেমায়েতকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু হেমায়েত রয়ে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র‌্যাব নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারী পরিচালনা করে।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-৩ এর অভিযানে বুধবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে হেমায়েতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সময় তার কাছ থেকে কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ১২৯টি আংটি, ১টি বক্স , ৩টি শঙ্খ, ‘আলাদিনের চেরাগ’ ১টি, ক্রেস্ট ২টি, কবিরাজি বই ১৫টি, পিতলের পাঞ্জা ১টি ও কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মনু হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলে জানায় র‌্যাব।

হেমায়েত র‌্যাবকে জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর বয়স ধরে কবিরাজি করছেন। হেমায়েত স্বীকার করেন, কবিরাজির নামে নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ উপার্জন করতেন। তার বাবা মো. সামসুল হক খানও কবিরাজি পেশায় ছিলেন। তার কাছ থেকেই কবিরাজির বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শিখে নেন হেমায়েত।

র‌্যাব মুখপাত্র জানান, মূলত নারীরাই ছিল হেমায়েতের প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৩ সালে সে তার স্ত্রী সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজির নামে প্রতারণা শুরু করে। কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী সোবহান ছিল ওই হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

র‌্যাব জানায়, ২০০৫ সালে জানুয়ারি মাসে সোবহান মনুকে মাথা ব্যাথার অসুখকে মানসিক রোগ বলে কবিরাজি চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসে। মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন এবং প্রতিমাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য টাকা পাঠাতেন। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা ও স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে মনু লক্ষাধিক টাকার মালিক হন। এই অর্থের প্রতি হেমায়েতের দৃষ্টি পড়ে। হেমায়েত মনুর সরলতার সুযোগে তার টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে।

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মনুকে বিভিন্ন ভেষজ উপাদানের মাধ্যম নিয়মিত ঘুমের ওষুধ দেয়া শুরু করেন হেমায়েত। এক পর্যায়ে মনুকে তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা পয়সা শত্রু পক্ষের জ্বীনের আক্রমণে পড়তে পারে বলে ভয় ভীতি দেখায় এবং এসব নিরাপত্তার জন্য হেমায়েত পীরের নিকট জমা রাখার জন্য মনুকে উদ্বুদ্ধ করে। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে ভিকটিম মনুর ঘুম হয় এবং মাথা ব্যাথার সমস্যা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েতের ওপর আস্থা তৈরি হয়। পরবর্তীতে মনু বেগম সরল বিশ্বাসে তার টাকা পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েতের কাছে জমা রাখে। পরে হেমায়েত তাকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে। পরে মনুর জ্ঞান ফিরে আসলে সে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করতে যেতে চাইলে মনুর সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সোবহানের সহযোগিতায় হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে ও শেষ পর্যন্ত গলা কেটে হত্যা করে। এরপর রাতের অন্ধকারে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের পাশে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে রাখে।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, হত্যাকাণ্ডের পর বাগেরহাট সদর থানায় হত্যা মামলার খবর পেয়ে সে বাগেরহাট থেকে পালিয়ে যশোরে একটি মাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরের দিন অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আজমীর শরীফ যায়। সেখানে সে কবিরাজি পেশাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৩ বছর অবস্থান করে। ২০০৮ সালে আবার অবৈধ পথে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করে। এসময় সে নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে মো. জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করে। একটি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিয়েও করেন হেমায়েত। মিরপুরেও হেমায়েত পুরাতন পেশা কবিরাজির মাধ্যমে প্রতারণা করতে থাকে। মানুষের ‘ভাগ্য পরিবর্তনের তাবিজ, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূরীকরণ তাবিজ, বশীকরণ তাবিজ’ ইত্যাদির কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে প্রতারণা করত।

মিরপুরে ৩ বছর থাকার পর তার প্রতারণার বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হলে সে ঠিকানা পরিবর্তন করে কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং সর্বশেষে বিগত ৫ বছর ধরে মোহাম্মদপুরের বসিলার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে আসছে। বসিলায় একইভাবে সে কবিরাজি ব্যবসা করতে থাকে। তাবিজ দেয়ার পাশাপাশি জ্বীনের বাদশা তার বশবর্তী আছে জানিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কথা বলে নতুনভাবে প্রতারণা শুরু করে। হাতিয়ে নেয় প্রচুর অর্থ। মূলত সে নারীদের টার্গেট করে জ্বীনের বাদশার মাধ্যমে নারীদের শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করত।

র‌্যাব আরও জানায়, হেমায়েতের বিরুদ্ধে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে ২০১২ সালে করা একটি মামলা রয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালে সে তার কবিরাজি কাজে ব্যবহৃত কষ্টি পাথরের মূর্তি রাখার দায়ে চোরাকারবারি হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হাতে ধরা পড়ে দেড়মাস হাজতবাস করে। মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। গত দুই মাসের মধ্যে সে কিছুদিন পর পর পিরোজপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ এবং মিরপুরে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। পরিচয় গোপন রাখার জন্য সে মাঝে মাঝেই তার চুল দাড়ি রং পরিবর্তন, পোশাকের ধরন পরিবর্তন করত। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।