আপডেট : ১৭ মার্চ, ২০২৪ ২২:৩৩
অবন্তিকার আত্মহত্যা: অভিযুক্তদের প্ররোচনার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক, জবি ও জাবি প্রতিনিধি




অবন্তিকার আত্মহত্যা: অভিযুক্তদের প্ররোচনার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশ

ছবি: সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, পুলিশ তার প্রাথমিক সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। শনিবার রাতে অবন্তিকার মা তসলিমা বেগম বাদী হয়ে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন। ওই মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে আসামি করা হয়েছে। সেই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আজ রোববার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ মহিদ উদ্দিন জানান, ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্তরা নজরদারিতে ছিলেন। কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা হওয়ার পর তাদের আটক করা হয়। কুমিল্লা জেলা পুলিশের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার তদন্তে এখন তারা বিশদভাবে খতিয়ে দেখবেন যে, তাদের প্ররোচনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা কতখানি গভীর।

মহিদ‌ উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামের জড়িত থাকার বিষয়টির খণ্ডিত সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে সব অভিযোগ পূর্ণাঙ্গ এবং যেভাবে কথা আসছে সেভাবে মিলে গেছে এমনটা বলা যাবে না।

তিনি বলেন, তবে প্রাথমিকভাবে সত্যতা আছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই সংশ্লিষ্টতার গভীরতা কতখানি সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আমাদের যতটুকু কাজ ছিল সেটুকু আমরা করে দিয়েছি, এখন কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা পুলিশ তদন্ত করবে।

অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ধরনের আত্মহনন অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা সবাই বিশ্বাস করি- যেকোনো ধরনের আত্মহনন ধর্মীয়ভাবে অন্যায়, সামাজিকভাবেও অন্যায়। আমরা মনে করি প্ররোচনাকারী ব্যক্তিও সমান অপরাধী। যদি কারও প্ররোচনা থেকে থাকে তবে সেটি বেরিয়ে আসবে। সে অনুযায়ী যারা যারা জড়িত থাকবে, আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

তদন্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনাটি বড় পরিসরে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য ড. সাদেকা হালিম। তড়িঘড়ি না করে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি উপাচার্যকে দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

উপাচার্য বলেন, অবন্তিকার বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক অভিযুক্ত দুজনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এটা কঠিন সিদ্ধান্ত হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়েছে। তৎক্ষণাৎ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্যদের নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তারা তাদের কাজও শুরু করে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘তদন্তে বড় পরিধিতে সবকিছু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেই দেখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন আছে, সেই আইন মোতাবেক প্রশাসন কাজ করছে। এই ধরনের নজির বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। এসব বিষয়ে তড়িঘড়ি করে তদন্ত করলে কিন্তু দুর্বলতা থেকে যায়। তবে আমরা খুব দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাব বলে আশা করছি।’

সাদেকা হালিম আরও বলেন, ‘পূর্ববর্তী যত ঘটনা আছে সেগুলোর সবগুলো পরবর্তী সিন্ডিকেটে উত্থাপন করা হবে। এটা আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’

ছাত্র ইউনিয়নের মানববন্ধন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) সংসদ। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনের সড়কে এ মানববন্ধন করেন তারা। মানববন্ধনে বক্তারা অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে ঘটনার পেছনে থাকা দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান।

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, ‘অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাকে দীর্ঘদিন ধরে সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বারা মানসিক টর্চার করা হয়েছে। দেশে নারীদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও নারীরা এখনো নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও যেভাবে নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে, তা আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’

জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইমন বলেন, ‘আমার এখানে দাঁড়িয়েছি জগন্নাথের অবন্তিকার জন্য এবং আরও নাম না জানা অনেক অবন্তিকার জন্য যাদের ঘটনা এখনো সামনে আসেনি। অবন্তিকার নিপীড়নের পর যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এর পেছনে দায়ী একটি কাঠামোগত অব্যবস্থাপনা। এই কাঠামোতে এমন শক্তিশালী বলয় কাজ করে যাদের ছত্রছায়ায় নিপীড়ক তৈরি হয়।’

তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও নিপীড়নের কারণে একজন শিক্ষককে (মাহমুদুর রহমান জনি) বরখাস্ত করা হয়েছে, সেই ঘটনায় ভুক্তভোগী ছাত্রীকে দায়মুক্তি পত্র লেখানোর অভিযোগ রয়েছে প্রক্টরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে আরেকজন সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধেও। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং সহকারী প্রক্টরের কাজ কি নিপীড়ন করা আর নিপীড়ক তৈরি করা? সব জায়গায় প্রক্টর কিংবা সহকারী প্রক্টররাই কেন নিপীড়নে সহায়তা করে? এই ক্ষমতাকে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে। প্রশ্ন না করলে এ রকম দিনের পর দিন ক্যাম্পাসগুলো নিপীড়ন তৈরির কারখানা হয়ে যাবে।’

মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, সহ-সভাপতি মুক্তারুল ইসলাম অর্ক প্রমুখ।

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও ‘পিসি পার্ক স্মরণিকা’ নামের ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা গলায় রশি বেঁধে ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর ১০ মিনিট আগে নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে তিনি এ ঘটনার জন্য আম্মান সিদ্দিকী নামে তার এক সহপাঠীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। অবন্তিকার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তার সহপাঠীরা এবং কুমিল্লায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে। অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে ১২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।