আপডেট : ১৮ মার্চ, ২০২৪ ১২:৩২
অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিপণনে কৃষকের লাভ কি?
 ড. মিহির কুমার রায়

অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিপণনে কৃষকের লাভ কি?

পেঁয়াজের একটি বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে খাদ্য উপকরণে যেমন- পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে, ক্যালসিয়াম-সালফার-ভিটামিন সংযোজনে, শরীরের তাপমাত্রা কমাতে, লিভারের হজমশক্তি বাড়াতে, ত্বকের সমস্যা নিরসনে, ক্যানসার ও ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে বছরে ২৪ লাখ টন। আবার উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ (প্রায় ৩০ শতাংশের মতো) বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয় বিধায় মোট ঘাটতি ৮ থেকে ৯ লাখ টন থেকেই যায় যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়, প্রতি বছরই যা স্বাভাবিক নিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে আমদানি ও উৎপাদন মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৩৪ লাখ টন। দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন এবং প্রতিদিন সারা দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৬ হাজার টন আর ঢাকা শহরেই চাহিদা প্রতিদিন দেড় হাজার টন। সাধারণভাবে তিন ঋতুতে পেঁয়াজের চাষ হলেও বর্ষায় এর চাষ বেশি হয় যদিও বন্যার একটা অনিশ্চয়তা কিংবা বর্ষার একটি সংকট রয়েই যায়। তারপরও যে বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়, সে বছর আবার কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং পরবর্তী বছরে পেঁয়াজ চাষে কৃষক আর উৎসাহিত না হয়ে অন্য ফসলে চলে যান। যার ফলে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যায় পরবর্তী বছরে।

দেশের বাজারে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্থিতিশীল। ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় তিনগুণ। সাধারণত প্রতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বা হালি পেঁয়াজ তোলেন কৃষক। তবে এবার দাম বেশি থাকায় আগেভাগেই উত্তোলন শুরু করেন চাষিরা। এতে তারা লাভবান হলেও সার্বিকভাবে দেশের মোট উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। নির্ধারিত সময়ের আগেই অপরিণত পেঁয়াজ উত্তোলন শুরু হওয়ায় সরকারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তবে কৃষকরা বলছেন, শুধু বাড়তি দাম নয়, বরং ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দর কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন চাষিরা।

পেঁয়াজের সিংহভাগ উৎপাদন হয় রবি মৌসুমে। এ মৌসুমে মুড়িকাটা ও হালি দুই জাতের পেঁয়াজ চাষ করেন কৃষক। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাসের প্রথম দিকে কন্দ বা মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়। এরপর চাষ করা হয় চারা বা হালি পেঁয়াজ। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ দিকে মাঠ থেকে মুড়িকাটা পেঁয়াজ কাটা শুরু হয়। মধ্য মার্চ থেকে পুরোদমে হালি পেঁয়াজ তোলা শুরু হয়। যদিও চলতি মৌসুমে দাম বেশি থাকায় নির্ধারিত সময়ের ১৫-২০ দিন আগেই কৃষক পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করতে শুরুও করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে চারা বা হালি পেঁয়াজ ১ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে, মুড়িকাটা বা কন্দ পেঁয়াজ ৬৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর ও বীজ পেঁয়াজ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। গত বছরে এ সময়ে দাম ছিল কেজিপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় তিনগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন দাম বেশি থাকলেও ভারত থেকে আমদানি হলে সামনে দাম কমে যেতে পারে। ফলে কৃষক দ্রুত তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন।

পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় একটি জেলা পাবনা। এখানকার পেঁয়াজ সারা বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। জেলার সুজানগরের চাষি আবেদ আলী এ বছর ৩৬ শতক জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। এরই মধ্যে তিনি ৩৭ মণ উত্তোলন করেছেন। যদিও এ জমিতে কমপক্ষে ৪৫ মণ ফলন হওয়ার কথা। তিনি ৩৭ মণ বিক্রি করে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। কিন্তু অন্য বছর ফলন এর চেয়ে বেশি হলেও সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করা যেত। পাবনায় এ বছর ৯ উপজেলায় ৫৩ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ; কিন্তু আবাদ হয়েছে ৫২ হাজার ৬৪০ হেক্টরে। এ জমিতে প্রাথমিকভাবে ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৬ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই উত্তোলন শুরু হওয়ায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজবাড়ীতেও চলতি বছর বেশি লাভের আশায় অপরিণত পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন কৃষক। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় এক হাজার হেক্টর বেশি। জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭০ হাজার টন। যদিও কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভালো দাম পেয়ে চাষিরা যেভাবে উত্তোলন শুরু করেছেন এভাবে চলতে থাকলে জেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। রাজবাড়ীর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে কেজিপ্রতি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায় আর খুচরায় ১০০-১১০ টাকা। তবে বাজারে আসা এসব পেঁয়াজ এখনো পরিপক্ব হয়নি। সাধারণত গাছ মারা যাওয়ার পর পেঁয়াজ পরিপক্ব হয়; কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সবুজ রঙের গাছ থেকেই কৃষক পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন। কৃষক বলেন, ‘সামনে ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দাম কমে যেতে পারে। ফলে এখন কাঁচা পেঁয়াজ তুলে বিক্রি করছেন চাষিরা।’ রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলেন, ‘অপরিপক্ব পেঁয়াজ না তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তার পরও বেশি দামের আশায় উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।’ ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কৃষকরা জানান, ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগেই তারা পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন। কৃষক বলেন, ‘বর্তমানে উৎপাদন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত যে পরিমাণ খরচ হয় তাতে ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে প্রবেশ করলে দেশি পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। এতে লাভ করা তো দূরের কথা উল্টো লোকসানের মুখে পড়তে হবে। তাই পরিপক্ব হওয়ার আগেই বিক্রি করছি।’ সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এ বছর উপজেলায় ১১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় কিছু জমির পেঁয়াজ উত্তোলন করছেন চাষিরা। আর ১০-১২ দিন পর উত্তোলন করলে ঘরে রাখতে পারবেন। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫৪ টন। রোপণ করা হয়েছে ৩ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে। একজন কৃষক জানান, চরে পেঁয়াজ চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১৩-১৫ হাজার টাকা। এক বিঘা জমিতে গড়ে ৪০-৫০ মণ ফলন হয়। খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ৪০-৪৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। রমজান মাস বলে ৮০-৯০ দিনের পেঁয়াজ উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, পেঁয়াজ সাধারণত ১১০-১২০ দিনের মধ্যে উত্তোলন করলে ফলন ভালো মানের হয়। সেই সঙ্গে দেখতে হবে গাছের পাতা হলুদ ও গোড়া নুয়ে পড়েছে কি না। এমন হলে পেঁয়াজ জমি থেকে তুলে নিতে হবে। এ ছাড়া কৃষক স্বভাবতই লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবেন। তার পরও পেঁয়াজ পরিপক্ব অবস্থায় জমি থেকে তুলে শুকিয়ে বিক্রির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যারা আগাম পেঁয়াজ আবাদ করেন তারা মার্চ থেকে উত্তোলন শুরু করেন। এ বছর দাম বেশি। তাই কৃষক আগেভাগেই তুলে ফেলতে চাইবেন, সেটা স্বাভাবিক। কৃষক বিক্রি করলে সেখানে তাদের নিষেধ করার সুযোগ নেই। তবে অপরিণত পেঁয়াজ তুলে ফেললে সামগ্রিক উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। বছরের শেষদিকে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। মূলত অনিশ্চিত বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকরা তাদের দাম নিয়ে সব সময় শঙ্কায় থাকেন। বাজারে দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে তারা অপরিণত পেঁয়াজ তুলতেন না। আমাদের বাজারে দাম হঠাৎ ওঠানামা করে। ভারত আমদানি বা রপ্তানি করবে এমন সিদ্ধান্তেও দাম ওঠানামা করে।

তারপরও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পরনির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বিশেষত কৃষিজাত পণ্যের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরমার্শ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। দেশের মাটি ও আবহাওয়া পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এবং বছরে ২ থেকে ৩ বার চাষ করার মতো উফশী জাতের বীজ রয়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চাষ, পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ ও পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় ওয়্যার হাউস নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। পেঁয়াজ আমাদের দেশে মূলত শীতকালীন ফসল যা দেশের ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে আর ৩০ শতাংশ নিয়ে জাতির চিন্তা। এখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-২ এবং বারি পেঁয়াজ-৫ জাতের ৩টি গ্রীষ্মকালীন জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি মসলাজাতীয় ফসল যা পৃথিবীব্যাপী উৎপন্ন হয় এবং সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় ভারত ও চীন দেশে বিশেষত আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম হয় আর হালকা শীত থাকে। আমদানি বাণিজ্যে আমদানিকারকদের সব বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে, টিসিবির কার্যক্রম ভোক্তাবান্ধব হতে হবে, বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে, বাজার স্থিতিশীল হতে হবে, সঠিক নিয়মে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষ করতে হবে ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে মূল্য বিপর্যয়ের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না যা কৃষক, ভোক্তা ও সরকারের জন্য একটি স্বস্তির বিষয় হতে বাধ্য। সর্বোপরি পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাস্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা।