আপডেট : ৩ এপ্রিল, ২০২৪ ১২:৫৬
আজ বাবা হারানো দিন
আলমগীর খোরশেদ 

আজ বাবা হারানো দিন

বাবা- এমন একটি সম্বোধন, একটি শব্দ- যা কানে প্রবেশ করে, মস্তিষ্কের নিউরনে কম্পন দিয়ে, কখনো আনন্দ কখনো বা বিষাদে দুচোখের কোণকে শিশির বিন্দুতে ভিজিয়ে দেয়। বাবা বলতে মধ্যবয়সি একজন মানুষ, সারাদিন যাপিতজীবনের ভার বয়ে বিকেল বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। ঘরে রেখে যাওয়া বাবুটার জন্য সাধ্যানুযায়ী কিছু কিনে, দরজার ওপার থেকেই আদরের ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরা। যত দাবি, আবদার, চাওয়া, অসুস্থ হলে ডাক্তার, ওষুধ, পথ্য, শিয়রের পাশে বসে থাকা সারারাত, সব কিছুর যোগান দিতেই যেন বাবারা আসেন পৃথিবীতে।

আঁতুড় ঘরে জন্ম নেওয়া নবজাতককে সাবধানে মায়ের কোল থেকে প্রথম টেনে নেন- বাবা। নিজের সব অপরাগতা, কষ্ট, অভাববোধকে আড়াল করে- আদর, শাসন, গাম্ভীর্য, হাসি, ধমক, মেনে নেওয়া মনোভাব, হাজারও আবদার যোগান দেন যিনি তিনিই- বাবা। পৃথিবীতে সব সম্পর্কের বিকল্প হয়, কেবল হয় না- বাবা, মা আর সন্তান। এদের মাঝে বিরাজ করে ঐশ্বরিক একটা আয়নিক বন্ধন। সম্পর্কের জোরে হয়তো বাবা-মা হয়ে যায় কিন্তু তারা কখনোই সত্যিকারে বাবা বা মা হতে পারে না। লোক দেখানো মেকি হয়।

আজ চব্বিশ বছর- আমার বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে, যেখানে গেলে কেউ কোনোদিন ফিরে আসে না। বাবাকে হারিয়ে এক বছরও গড়ালোনা, আমার মায়াবতী মা-ও বাবার সাথে দূর আকাশের তারা হয়ে প্রতিসন্ধ্যা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত চেয়ে থাকেন, অপলক নেত্রে, কিছু হয়তো বলেন; কিন্তু দূর আকাশের তারাদের ভাষা তো আমার জানা নেই। বুঝব কেমন করে? আমার বাবা জান্নাতবাসী এ কে খোরশেদ উদ্দিন আহমেদ, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার নারান্দী ইউনিয়নের একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন, কিশোরগঞ্জ মাল্টিপারপাস সোসাইটির দুই বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। জেলা সেরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তখনকার সময় ছয় হাজার টাকা পুরস্কার পান। সমুদয় টাকা পাকুন্দিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও নারান্দী হাই স্কুল স্থাপনে দান করেন। আগে ওইখানে উইভিং ফ্যাক্টরি ছিল। বাবা এসডিও সাহেব মি. কাজিম ও ময়মনসিংহের ডিসি এম মনিরুজ্জমান সাহেবকে এনে জনসভা করে পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি সরিয়ে ওই জায়গায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে অনুমতি নেন। আজকের প্রজন্ম জানেনা এসব। স্বীকারও করে না কেউ। পরিবারে সবার ছোট প্রতিনিধি এই আমি আব্বার যৌবন বয়সের কীর্তিময় সাফল্য ধারা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আম্মার কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি। আমার বাবা কলকাতা শহরে পুলিশে চাকরি নিয়ে শুরু করেন জীবনযাত্রা। পরে এই চাকরি ছেড়ে, কৃষি সুপারভাইজার পদে মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। যার বুকের ভিতর খেলা করে স্বাধীনচেতা মনোভাব, গদবাঁধা জীবন ভালো লাগবে কেমন করে? আবার চাকরি ছাড়েন বাবা। দেশে এসে পাকুন্দিয়া থানা বাজারে শুরু করেন সোডা ও সিমেন্টের ব্যবসা, ডিলারশিপ নিয়ে। শুরু হয় জীবনের পটপরিবর্তন।

রাজনীতি আব্বাকে টানত আগে থেকেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির পিতা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছবি বাঁধাই করে আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় টানিয়ে রাখতেন আব্বা। রাজনীতিতে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন আব্বা। তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহুকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি নির্বাচিত হন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করে প্রকাশ্য জনসভা থেকে গ্রেপ্তার হন বাবা। রাজবন্দি হিসেবে কারাবরণকারী আমার বাবা ছিলেন ইংরেজি জানা তুখোড় বক্তা। ডেলিগেট বক্তা হিসেবে আব্বা বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা করেছেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় আব্বার হাতের লেখা বই ‘হবু চন্দ্র রাজা ও গবু চন্দ্র মন্ত্রী’ তখন রাজনীতিতে সাড়া পড়ে গেছিল। ফলে আব্বা সরকারের রোষানলে পড়েন।

আব্বার জীবনদর্শন, কথা, কাজ, অ্যাকটিভনেস, সিনসিয়ারিটি ছিল অনুকরণীয়। এত সিনসিয়ার, নিয়মানুবর্তিতা, সারাজীবনে আর কাউকে দেখিনি আমি।

মনে পড়ে, আমি তখন দেশের বাইরে। আব্বা আমাকে চিঠি লিখতেন। আমরা চিঠির যুগের মানুষ প্রযুক্তিগত সুবিধা ছিল না তখন। চিঠিতে মাইডিয়ার আলম- দিয়ে শুরু করতেন আব্বা। টানা অক্ষরে সুন্দর লেখা ছিল বাবার। ইংরেজি হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল তার। আজকাল চিঠি হারিয়ে গেছে, কেউ লেখে না। বাবা আমাকে লিখতেন-

: মনে রাখবে, ঘর থেকে দু’পা বেরুলেই সেটা বিদেশ। দূরে আছো- ভালো আছো, সংসারটা সমরাঙ্গন। তখন বুঝতাম না, কেন এসব লেখেন আব্বা? আজ বুঝি, সংসার কত জটিল, কত পিচ্ছিল এর পথ। আব্বা আরও লিখতেন-

: ভদ্রলোকের ভাত নেই। সহজ-সরল একটা গুণ হলেও সেটা এখন মূল্যহীন, মানুষ বোকা ভাবে।

যা আমি নিজের জীবনের উপলব্ধি থেকে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

আমি গ্রামে বড় হয়েছি। বৈশাখ মাসে ঝড় এলেই আব্বা সবাইকে ডাকাডাকি করে তার ঘরে নিয়ে আসতেন। তুফান শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হতো আব্বার কাছে।

মনে পড়ে বাড়িতে আব্বা তিন বেলায়-ই আমাদের সব ভাইবোনদের ডেকে এনে একসাথে খেতেন। আমাদের বাড়ির সামনে বড় পুকুর। আব্বা গোছলের সময় আমাকে ডেকে নিতেন সবসময়। পানিতে নেমে আব্বার কাঁধে উঠতাম। ছোট বলে সাঁতার শেখা হয়নি তখনো। আমাকে কাঁধে নিয়ে আব্বা পানিতে ডুব দিতেন। আমি তো ভয়ে শেষ। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করতাম

: আব্বা তাড়াতাড়ি উডো, আমার ডর করতাছে,

আব্বা পানির নিচ থেকে মাথা উঠিয়ে বলতেন

: ভয় কিরে? আমি আছি না?

আব্বার সেই ‘ভয় কিরে, আমি আছি না?’- কথাটা আজও আমার কান, মন, অনুভূতিকে জাগিয়ে দিয়ে যায়। এমন করে নির্ভতার আশ্বাস কে দেবে? কেউ বলেনি কোনোদিন, হয়তো বলবেও না সারা জীবন।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির ষাঁড় গরুটা কখন দড়ি ছিঁড়ে এসে আমাকে পেছন থেকে ঘাড়ে গুঁতা দেয়। আমি মাটিতে পড়ে যাই। রক্ত পড়ছিল ঘাড় থেকে আমার। আব্বা খুব বকেছিলেন কাজের ছেলেটা ও আম্মাকে। প্রথম জনের দোষ, পুরাতন পচা দড়ি দিয়ে ষাঁড় বাঁধল কেন, আর আম্মাকে বকলেন, ছোট ছেলেটাকে সামলে রাখতে পারে না কেন? মনে পড়ে, আমার কোনো জ্বর বা অসুখ হলে, আব্বা দশ-পনেরো মিনিট পর পর এসে জিজ্ঞাো করতেন-

: কিরে জ্বর কমেনি এখনো?

মনে মনে বিরক্ত হতাম কিন্তু আজ অসুখ হলে, হাসপাতালে গেলেও দেখার কেউ নেই। পনেরো মিনিট কেন, পনেরো বছরেও কেউ জানতে চায় না-

: কিরে কেমন আছিস, আলম? বাচ্চারা ভালো?

আজ নিজে বাবা হয়েছি। সন্তান আর বাবার মধ্যকার রসায়নটা যখন বুঝতে শিখলাম তখন বাবা হারিয়ে গেছেন। কষ্ট লাগে এই বোধটা যদি আগে হতো, তাহলে অন্তত একটা দিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম

: বাবা, ইউ আর মাই সুইট অ্যান্ড গ্রেট পাপা, আই লাভ ইউ।

এখন নিজে বাবা হয়ে বলতে ইচ্ছে করে-

: আব্বা, বাবা হওয়া এত কষ্ট? এত ছাড় দিতে হয়, গোপন রাখতে হয় যাপিতজীবনের কষ্টগুলো, হাসিমুখে হজম করতে হয় কত না কষ্টের পদাবলি।

আমার একমাত্র ছেলে ভার্সিটিতে। তেরো বছরে রাজকন্যা সপ্তম শ্রেণিতে। আমার রাজকন্যা আমার মায়ের কষ্ট ভুলিয়ে রাখে ওর ধমক, শাসন আমার কড়া বাবাকে মনে করিয়ে দেয়। অফিসে যাওয়ার সময় চিরুনি হাতে নিয়ে আমার টাকমাথার শেষসম্বল কটা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে

: আব্বুটা টাকলু কেন আমার?

আমাকে ছাড়া ও রাতে ঘুমায়না। ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি- বলে তারপর ঘুম পাড়াই।

আমার যদি কখনো মন খারাপ লাগে, শুয়ে থাকি। আমার রাজকন্যা চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আমি তখন আমার মা-বাবার স্মৃতিকে চুপ করে থেকে রোমন্থন করি।

আজ ২৩ রমজান, চব্বিশ বছর আগে এমনি দিনে আব্বা আমাদের ছেড়ে যান না ফেরার দেশে। আমার মাথার ওপর ছাদটা তখন থেকে সরে যায়, সারাজীবনের জন্য। ওপারে ভালো থাকুন বাবা।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক