আপডেট : ৩ এপ্রিল, ২০২৪ ১২:৫৯
বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও বাংলাদেশ
ফারিহা তাসনোভা

বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও বাংলাদেশ

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত হলো এমন একটি মাপকাঠি যার দ্বারা বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান কিংবা অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধরনা লাভ করা যায়। আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্মরণকালে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল যা কি না বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি অর্জন; কিন্তু সাম্প্রতিককালে তা হ্রাস পেয়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে তিন থেকে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে ডলারের দাম বৃদ্ধি সব কিছুর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এতে পরিলক্ষিত।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান একটি খাত হলো- তৈরি পোশাকশিল্প থেকে অর্জিত রপ্তানি আয়। স্বাভাবিকভাবেই রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকট তৈরি হবে। আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের অধিক আসে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বারা প্রেরিত রেমিট্যান্স আয়ের ওপর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অনেকাংশে নির্ভরশীল। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পারব, দেশের প্রধান দুটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত থেকে আমরা প্রত্যাশিত ফলাফল আদায়ে অনেকাংশে ব্যর্থ। কেননা, দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিনির্ভর। যার ফলে তৈরি পোশাক খাত থেকে আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি তা অনেকাংশেই কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা শতভাগ মূল্য সংযোজন করতে পারছে না।

অন্যদিকে, ডলারের মূল্য বাজারভিত্তিক না হওয়ার ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে দেশে টাকা পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অবৈধ পথ তথা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে যার ফলে প্রবাসীদের অর্জিত ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে এবং দেশ রেমিট্যান্স আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রিজার্ভ সংকট মোকাবিলার জন্য তাই আমাদের উচিত তৎপর হওয়া। তৈরি পোশাকশিল্পের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রাখতে পশ্চাৎপদ শিল্প বিস্তারে মনোযোগী হতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্পের আনুষঙ্গিক তথা পশ্চাৎমুখী পণ্যসামগ্রী যেমন- কাঁচামাল, মেশিনারিজ দেশেই তৈরিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই সংরক্ষিত হবে। অন্যদিকে, বাজারভিত্তিক বৈদেশিক মুদ্রার মান প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করবে। অর্থনৈতিক প্রণোদনার পাশাপাশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা জনগণের জন্য আরও সহজ, হাতের নাগালে নিয়ে আসতে পারলে জনগণ বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে উৎসাহিত হবে। অনলাইনভিত্তিক রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘরে বসে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ ও আদায়ের সুব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম করবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকট নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ২০৩১ সালে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক: এমবিএ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিনিয়র ব্যাংকার, জনতা ব্যাংক পিএলসি