চিত্রদা আমার মৃৎশিল্পের শিক্ষক। বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণির চিত্রশিল্পী। কিছু কারণে তার আসল নামটা ব্যবহার করতে পারলাম না। রূপক নাম ব্যবহার করতে হলো।
কোভিড-19 চলাকালে সারা পৃথিবী যখন স্তব্ধ, অচল, তখন আমি চিত্রদার কাছে মাটির ভাস্কর্য, টেরাকোটা, পটারী ইত্যাদি মৃৎশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিই। তার বাড়ির নিচ তলায় পুরো ফ্লোরজুড়ে স্টুডিও। নাম বার্ন্ট ক্লে স্টুডিও। মাটির বানানো জিনিসগুলো তার নিজস্ব গ্যাস চুল্লিতেই পোড়ানো হয়।
আমার ব্যাচে যারা ছিলেন তারা সবার ব্যাকগ্রাউন্ড চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা। শুধু আমি আর তনু ছিলাম অন্য ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা। সবাই যার যার পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত। একজন নামকরা কলেজে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির একজন বুদ্ধিজীবীর কন্যা। আমরা রঞ্জনাদি ডাকতাম। তনু মেজর জিয়ার স্ত্রী। বিউটি আগা খান স্কুলের শিক্ষিকা। পুরো ব্যাচে একটাই ছেলে ছিল নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। অনেক জুনিয়র তাই আমরা সবাই ওকে অনেক আদর করে নাম ধরেই ডাকতাম ছোটভাইয়ের মতো। খুব ভালো আর্ট করে। চিটাগাং থেকে এক কর্নেলের ওয়াইফ ছিল।
আর হচ্ছি আমি- এই কজন মিলেই ছিল আমাদের ব্যাচ।
এবার গল্পের প্রয়োজনে সবার বৈশিষ্ট্য একটু বিশ্লেষণ করতে চাই।
তনু খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে।
গল্প করতে ভালোবাসে। অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে বলা যায়।
মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য কেক, পুডিং, বিস্কিট, হালুয়া হাতে বানিয়ে এনে খাওয়াতো।
এক কথায় খুব আদুরে মেয়ে। ও সেনানিবাসে থেকে অভ্যস্ত তাই সিভিলদের সঙ্গে মেশার সুযোগ কখনো হয়নি বাইরের মানুষের।
আমাদের পেয়ে অনেক হ্যাপি ছিল। আড্ডা দিতেও পছন্দ করত।
আর আগা খান স্কুলের শিক্ষিকা বিউটি চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পাস করা। তবে খুব চটপটে। চলাফেরার গতিও খুব দ্রুত এবং ছটফটে স্বভাবের। ঠিক তার উলটো ছিল রঞ্জনা দি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আমাদের ক্লাস চলত মাঝে দুইবার ব্রেক পাওয়া যেত। রঞ্জনাদি একেবারেই কথা বলতেন না প্রয়োজন ছাড়া। তবে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন।
চিটাগাং থেকে যে কর্নেলের ওয়াইফ এসেছিলেন- এক আশ্চর্যজনক ব্যবহার ছিল তার।
সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি কর্নেলের ওয়াইফ। কারও সঙ্গে মেশা তো দূরের কথা প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতেন না ঠিকমতো। তনুকে দেখতাম তার আশপাশেও বসতো না। আমি প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি।
আমার অভ্যাস হচ্ছে সবাইকে নিজ থেকেই যেচে পরিচয় হয়ে আপন করে নিই। আসলে যেহেতু সারাদিন ধরে ক্লাসে থাকতে হচ্ছে কে কি বানাচ্ছে, নানা রকমের বিষয় নিয়ে কথা বলতে হয়। আমি না বুঝেই তনুকে ডেকে আমার কাছে বসালাম। পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। ওখান থেকেই বুঝতে পারি ডিফেন্সের মানুষ সিভিলদের লাইক করে না। একটা ডিস্টেন্স তৈরি করে রাখে।
একবার তনু আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করেছিল ওদের সেনানিবাসে। আমরা নির্দিষ্ট দিনে যাই। মেইন গেটে সেনা প্রহরি আমাদের গাড়ি আটকায়। জানতে চাইল আগমনের কারণ?
বললাম মেজর জিয়ার বাসায় যাব। না বাংলাদেশের সাবেক মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়া নয়। পরের জেনারেশন তনুর হাসবেন্ডের নাম মেজর জিয়া। গার্ড কিছুক্ষণ আমাদের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। মনে হলো পৃথিবীর নতুন কিছু শুনে অত্যাশ্চর্য-এ আকাশ থেকে পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। আরও কিছু বলায় গেট ছেড়ে দিল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি গার্ড নিজের বোকামির জন্য নিজেই হাসছে।
আগা খান স্কুলের শিক্ষিকা বিউটি প্রায়ই বিভিন্ন দেশে চিত্র কর্মশালায় ওর ছবি পাঠাত, নিজেও সম্ভব হলে ঘুরে আসত।
স্বভাবে আমি ছিলাম একটু চটপটে, শিল্পী মানুষ গান, কবিতা আবৃত্তি নিয়ে গল্প হতো আমাদের শিক্ষক চিত্রদার সঙ্গে। তিনিও খুব গান, কবিতা আবৃত্তি পছন্দ করতেন। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের আড্ডাও জমে উঠত। সারাদিন হাসিখুশি গল্পে সবাইকে মাতিয়ে রাখতাম। চিত্রদাকেও ছাড়িনি, কাজ করতে করতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় তার ব্যর্থ প্রেমের গল্প শুনতে চাইতাম। দাদাও খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে মজা করে আমাদের তার বান্ধবীদের গল্প শুনাতেন।
একটা কথা বলে রাখি, আমি আমার চাকরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাইরে কাউকে স্যার শব্দটা ব্যবহার করি না। একমাত্র কলেজেই কলিগদের সঙ্গে সিনিয়রদের স্যার, ম্যাডাম শব্দগুলো ব্যবহার করতাম।
কারণ এত ফর্মাল জীবন ভালো লাগে না। দাদাও খুব মিশুক ছিলেন। আমাদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রী নয় বন্ধুর মতো মিশে গেলেন। একবার তার জীবনী লিখে আমাকে ভাষ্য পাঠ করতে বললেন। কণ্ঠ দিলাম তার লেখায়। সেটা নিয়ে তার বিভিন্ন ছবি অ্যাড করে একটা ডকুমেন্টারি বানালেন বুঝলাম। খুব খুশি তার কাজ করে দেওয়ায়।
আমিও হয়ে গেলাম তার প্রিয় ছাত্রদের একজন। এরপর একটা কবিতা ডুয়েট আবৃত্তি করেছিলাম তার এক বান্ধবীর লেখা কবিতায়।
আমরা কোর্স শেষ করে সার্টিফিকেট নিই। চিত্রদাও পুরো পরিবার নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান।
মাঝেমধ্যে আমাদের খোঁজখবর নেন।
মজার ব্যাপার হলো আমেরিকায় মার্কেটে বা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গেলে যেখানে যা কিছু ব্যতিক্রম শিল্পকর্ম দেখেন ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়ে দেন। কিছু কিছু শিল্পকর্মের ব্যাখ্যাও দেন। মাঝেমধ্যে আমাদের মধ্যে তর্কও হয় মন্তব্য নিয়ে।
আমার এই মন্তব্য এবং বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন যুক্তিতর্ক তিনি খুব পছন্দ করেন জানি। কারণ এই যুক্তিতর্ক থেকে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে।
সেদিন চাইনিজদের জিনিসপত্রের ডিজাইনের বৈচিত্র্যতা নিয়ে কথা উঠতেই চিত্রদা একটা পিতলের জলের কলের ছবি পাঠালেন। যা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। এর আগে চায়না, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জিনিসপত্রের ডিজাইন দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম ওরা প্রতিটি জিনিস নিয়ে প্রচুর রিসার্চ করে। তাই এমন নিত্যনতুন ডিজাইন প্রতিনিয়ত বানাতে পারছে।
এরপর কফি মেশিনের ডিজাইন আর জলের কলের ডিজাইন দেখে আমি সত্যি হতবাক হয়ে গেছি। এটাকে রুচির কোন পর্যায়ে ফেলব তাই বুঝতে পারছি না।
আমার রীতিমতো বমি উগরে আসছিল এসব ডিজাইন দেখে।
কফি বানানোর মেশিনটা হচ্ছে একজন বৃদ্ধ চাইনিজ মানুষের আকৃতি। হাফ প্যান্ট অর্ধ খুলে হাই কমোডে বসার পোজে বসে আছে। সুইচ দিলে অন হয়ে কফি তার পায়ুপথ দিয়ে বের হচ্ছে। সেটা কাপ দিয়ে কফি নিচ্ছে মানুষ।
বিষয়টা হলো বৃদ্ধ লোকটা মল ত্যাগ করছে আর মানুষ কাপে করে তা তুলে নিচ্ছে।
আর কিচেনের পিতলের জলের কলের ডিজাইন হলো-পুরুষাঙ্গ থেকে জল নিচ্ছে।
মানে পুরুষের মূত্র হলো কলের জল।
সত্যিকথা এসব ডিজাইনগুলো দেখে ভাবছি, আসলে ঘুরেফিরে আমার মনে হয় আদিম যুগেই ফিরে যাচ্ছি।
যেমন- মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক আবিষ্কার হয়েছিল। আর এখন সেই পোশাক অর্ধ খুলে, নগ্ন হয়ে করি পোশাকের ফ্যাশন।
অস্থির পৃথিবীতে আমরাও প্রতিযোগিতায় অস্থির হয়ে গেছি। বড় অস্থির আমাদের চিন্তা-চেতনায়।
এটাই কি আধুনিকতা? নাকি চরম নির্লজ্জতা?
কার সাথে, কিসের সাথে এই প্রতিযোগিতা করছি তা হয়তো মানুষ নিজেরাই জানে না।
যুগের পরিবর্তনে সমাজে ধীরে ধীরে নির্লজ্জতা, নগ্নতাকে ফ্যাশন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চলছে।
আর আধুনিকতার নামে আমাদের ইয়াং জেনারেশন তা গ্রহণ করে নিচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, সিএসই ডিপার্টমেন্ট, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা