ঘূর্ণিঝড় আসছে, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে হয়তো সে খবর অজানা। তাই নিরাপদ আশ্রয়ে না ছুটে তারা ঘরেই পড়ে থাকেন। কিংবা সতর্কসংকেত বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু উপকূলের জেলেদের কাছে হয়তো সে খবর তখনো পৌঁছায়নি।
বিপদ যখন একেবারে সন্নিকটে, ঠিক সে সময়ে মাত্র কয়েকটি শব্দে লেখা একটি খুদেবার্তা (এসএমএস) বা তথ্যই হয়তো উপকূলীয় মানুষদের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। সেই আশা থেকে খুদেবার্তায় তথ্য পাঠিয়ে সতর্কীকরণ আর নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরানোর জন্য একটি নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থা চালু করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এটির মাধ্যমে বার্তা যেত পাহাড় থেকে উপকূলে। কিন্তু এখন সেই নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থা আর আগের মতো সক্রিয় নেই।
২০১৭ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর উদ্যোগে চালু হওয়া এই জরুরি সেবা কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক’ (ডিআইএন)। এর অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম জেলার ১ হাজার ৮৩৬ ওয়ার্ডের প্রতিটির জন্য আলাদা দল গঠন করা হয়। প্রতি ওয়ার্ডে পাঁচ সদস্যের দলে ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য, শিক্ষক, গ্রাম-পুলিশ, ইমাম/পুরোহিত, ও স্কাউটস/এনজিওর কর্মীরা।
দুর্যোগের সময় সেই দলের প্রধানসহ ২০ হাজার মোবাইল ফোন নম্বরে সেকেন্ডেই বার্তা পৌঁছে যেত। এই দলের কাজ ছিল বার্তা পাওয়ামাত্র তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয়ভাবে মাইকিংয়ের মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা এবং সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া। পাশাপাশি বিপদের মুখে থাকা মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য এক প্রকার বাধ্য করতেন তারা। অবশ্য প্রচার-প্রচারণার ফলে আসন্ন দুর্যোগ আঁচ করতে পেরে আশ্রয়কেন্দ্রে নিজ থেকেও ছুটে যেতেন অনেক।
মূলত প্রচলিত পদ্ধতিতে টিভি কিংবা রেডিওতে দুর্যোগের সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হলেও স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামের মানুষদের মাঝে দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতির ব্যাপারে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনীহা দেখা দেয়। এই নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি সেই মানুষদের কাছে গিয়ে সতর্ক করে আগেভাগে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। একই কারণে দুর্যোগপূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগপরবর্তী সমন্বয় কাজেও গতি এসেছিল।
নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থাটির মাধ্যমে সাফল্য এলেও যার হাত ধরে এটি চালু হয়েছিল সেই জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী ২০১৮ সালের মার্চে চট্টগ্রাম থেকে বিদায় নেয়ার পর এর কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে দুর্যোগের সময় উপকূলীয় এলাকার মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগেও ভাটা পড়ে।
সর্বশেষ ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মৃত্যুর ঘটনা না থাকলেও গরিব মানুষরা সহায়সম্পদ হারিয়ে পথে বসেছেন। এই মানুষদের মধ্যে আছেন চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ হালিশহরের সমুদ্রলাগোয়া আকমল আলী রোডের জেলেপাড়ার বাসিন্দারাও। ঘূর্ণিঝড়ে পুরো পাড়াটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর গত মঙ্গলবার এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে পাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, তাদের সরে যেতে কেউ বলেনি।
জেলেপাড়ার বাসিন্দা পাখি দাস ও মিলিনি দাস দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সতর্ক করতে কোনো মাইকিং করা হয়নি। আমরা শেষ মুহূ্র্তে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে উঁচু জায়গায় চলে যেতে পারলেও কোনো জিনিসপত্রই বের করে নিয়ে যেতে পারিনি। আগেভাগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলে টাকাপয়সাসহ মূল্যবান জিনিস হারাতে হতো না।’
এই নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থা চালুর পেছনে ভূমিকা ছিল জেলা প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলামেরও। নেটওয়ার্ক-ব্যবস্থাটি বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ওই নেটওয়ার্ক কার্যক্রম বন্ধ হলেও আমরা এখন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে সচেতন করছি। এসব গ্রুপে স্বেচ্ছাসেবকসহ অনেকেই যুক্ত আছেন। তারা মানুষদের সচেতন করার কাজ করছেন।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা