আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্মের নাম ইসলাম। আলহামদুলিল্লাহ! মহান রাব্বুল আলামিন মহানবীর (সা.) ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল করার মাধ্যমে ইসলামকে পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদের জন্য। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণেই অন্যান্য ধর্মের চেয়ে ইসলাম স্বতন্ত্র ও মহৎ।
আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বাণীবাহক সর্বশেষ নবী, সাম্য, নারীর মর্যাদা, অন্যের হক আদায়, প্রতিবশী ও মা-বাবার প্রতি সদাচার সহমর্মিতা, উত্তম চরিত্র, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, অন্যের সম্পদ সুরক্ষা ইত্যাদি হচ্ছে ইসলাম ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে আকর্ষণ করে ইসলামের প্রতি।
আজ আমরা ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য আমানত বা পর সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনা করব।
মহান আল্লাহ বলেন ‘যে অন্যের হক নষ্ট করে সে ঈমানদার নয়’।
★ প্রিয় নবী (সা.) ছোটবেলা থেকেই আমানতদার ছিলেন। ছিলেন পরম বিশ্বাসী সবার কাছে। তাই তিনি ছিলেন ‘আল আমিন’ ছোটবেলা থেকেই। আর তাই খ্রিষ্টান, ইহুদি সব মতবাদের লোকেরাই তাকে বিশ্বাস করত এবং তার কাছে অতি মূল্যবান আসবাবপত্র গচ্ছিত রাখত। তিনি সেগুলো খেয়ানত বা নষ্ট তো করতেনই না। অধিকন্তু পরম যত্নে সেগুলো তিনি রক্ষা করতেন এবং চাহিবামাত্র আমানতকারীদের তা ফেরত দিতেন।
★পবিত্র কোরআনে বারবার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে আমানত রক্ষার প্রতি। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের কাছে পেশ করো না। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৮)
★আরও বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ করো বা ফেরত দাও। (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৫৮)
★প্রকৃত ইমানদার হওয়ার আলামত হলো আমানত রক্ষা করা। এ সম্বন্ধে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর (তারাই প্রকৃত মুমিন) যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত-৮)
★হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যদি তোমাদের মধ্যে চারটি জিনিস থাকে, তবে পার্থিব কোনো জিনিস হাতছাড়া হয়ে গেলেও তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
★আর সেই চারটি জিনিস হলো- এক. আমানতের হেফাজত করা। দুই. সত্য ভাষণ বা সত্য কথা বলা। তিন. উত্তম চরিত্র। চার. পবিত্র রিজিক বা হালাল উপার্জন। (মুসনাদে আহমদ)
★ভেবে দেখার সময় হয়েছে। এই গুণগুলো আমাদের মধ্যে আছে কি না! দুনিয়ার লোভে পড়ে কোন পাপ কাজটি আমরা করি না। মিথ্যা কথা বলা থেকে শুরু করে আমানতের খেয়ানত পর্যন্ত সবই আমরা করে বেড়াই। লোক ঠকাই। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করি।
অথচ আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যার চরিত্রে আমানতদারি নেই, তার ইমান নেই। আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার দ্বীন নেই। (মুসনাদে আহমাদ)।
★অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তখন তা ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, তখন সে তার খেয়ানত করে। (বুখারি, মুসলিম)।
★রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এটাও একটি আমানত। এরও যথাযথ হেফাজত করতে হবে। মানুষের প্রাপ্য মানুষদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এখানে খেয়ানত করলেও আল্লাহতায়ালার কঠিন আজাবে পাকড়াও হতে হবে।
★ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) ঘোষণা করেছিলেন, আমার রাষ্ট্রের একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, এর জন্য আমিই দায়ী হবো।
*তিনি রাতের আঁধারে ঘুরে ঘুরে প্রজাদের খোঁজখবর রাখতেন। কেউ অভুক্ত থাকলে নিজের কাঁধে খাবারের বস্তা বহন করে তার বাড়িতে দিয়ে আসতেন।
★ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পরে এক রাতে তিনি বাতির আলোতে রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি বিশেষ প্রয়োজনে তার কাছে এল। আলী (রা.) সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে দিলেন।
তারপরে আগত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। আগন্তুক কৌতূহলী হয়ে তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দিলেন, এতক্ষণ আমি সরকারি কাজ করছিলাম। তাই সরকারি তেল ব্যবহার করেছি।
এখন তো ব্যক্তিগত কাজ করছি। সরকারি বাতি ব্যবহার করলে এটা আমানতের খেয়ানত হবে।
আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিসে নবীজি বলেছেন,
আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন, (১) অনর্থক কথাবার্তা, (২) সম্পদ নষ্ট করা এবং (৩) অত্যধিক সাওয়াল করা।
(সহি বুখারি: ১৪৭৭)
হাদিসে বর্ণিত ‘সম্পদ নষ্ট করা’ কথাটি অনেক ব্যাপক। চতুর্থ শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকিহ আল্লামা খাত্তাবি (মৃত্যু: ৩৮৬) এ প্রসঙ্গে অতি উত্তম ও সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, সম্পদ নষ্ট করার অনেক সুরত রয়েছে। তবে এর মূল কথাটি হলো, ব্যয় করার ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করা, অপাত্রে ব্যয় করা, প্রয়োজনীয় খাতে খরচ না করে অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করা। তিনি আরও লিখেছেন, একজন ব্যক্তির এমন কিছু সম্পদ রয়েছে, যেগুলোর যথাযথ যত্ন না নিলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন গোলাম, বাঁদি, গবাদি পশু প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রে এসবের যথাযথ ও প্রয়োজনীয় যত্ন না নেওয়াও হাদিসে বর্ণিত সম্পদ নষ্ট করার অন্তর্ভুক্ত হবে। (আল্লামা খাত্তাবি কৃত শরহে বুখারি)
বর্তমানে আমরা একটি প্রবণতা লক্ষ করে থাকি। অনেক বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্য কখনো বাচ্চাদের হাতে মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে দেন, কখনো তারা নিজেরাই ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে খেলাধুলা শুরু করে। বড়রা দেখেও তাদের হাত থেকে সেটা গ্রহণ করেন না। অথচ জিনিসটি তাদের হাতে নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা খাত্তাবি লিখেছেন, “বুঝমান নয় এমন কারও কাছে সম্পদ দেওয়াও ‘সম্পদ নষ্ট করার’ অন্তর্ভুক্ত। এখান থেকে প্রমাণিত হয়, নিজের সম্পদ নষ্ট করে ফেলে যেমন- শিশু, পাগল, এদের ওপর লেনদেনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা বৈধ রয়েছে।” তাছাড়া সূরা নিসার আয়াত ‘অবুঝদের হাতে তোমরা নিজেদের সেই সম্পদ অর্পণ করো না যাকে আল্লাহ তোমাদের জীবনের অবলম্বন বানিয়েছেন’ (আয়াত: ৫) এখান থেকেও এ ধরনের আচরণের অসঙ্গতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, শিশুদের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ আচরণ ইসলামের একটি বিশেষ শিক্ষা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শরিয়তের স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত বিধান লঙ্ঘন করা কাম্য নয়।
সম্পদের ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের আরেকটি ক্ষেত্র হলো রাগের মুহূর্তটি। কারও কারও অভ্যাস আছে তারা কোনো কারণে রেগে গেলে হাতের কাছে যা পান তাই ছুড়ে ফেলেন। এভাবে নিজের বা অন্যের সম্পদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভেঙে রাগ মিটিয়ে থাকেন। মূলত রাগ মানুষের স্বভাবজাত একটি অবস্থা। একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইসলাম বিভিন্ন পদ্ধতি শিখিয়েছে। রাগের সময় যত্নের সঙ্গে এগুলো অবলম্বন করতে হবে। যে সম্পদকে আল্লাহতায়ালা নেয়ামত বানিয়েছেন এবং সংরক্ষণ করার জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন, সেই সম্পদ নষ্ট করা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুখে-দুঃখে শান্ত রাগত- সর্বাবস্থায় আল্লাহপাকের বিধানের প্রতি নিজেকে সঁপে দেওয়াই হলো একজন মুমিনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
পবিত্র কোরআন ও হাদিস আমাদের তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বারবার নির্দেশনা দেওয়ায় একজন শুদ্ধ মুসলিম বা মুমিনের কাছে তাই অন্যের সম্পদ এবং অন্য ধর্মালম্বীরা সব সময় নিরাপদ এবং সুরক্ষিত।
*আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে ইসলামের ও মহানবীর মহান শিক্ষা অন্যের সম্পদ সুরক্ষা ও বিশ্বাস অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা