এমন নয় যে, অতীতে সিলেটে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি, মাঠ-ঘাট পানিতে ভরে যায়নি। তবে আগে বৃষ্টি হলেও পানি নেমে যেত দ্রুত, ফলে শহরে প্লাবন হতো না। আগের তুলনায় এখন শহরে বিশাল বিশাল দালান অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে, গত ১৪ বছরে শহরে বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারের নামে প্রায় ১১শ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সিলেটবাসী গত কয়েক বছরের মতো কখনও পাহাড়ি ঢল, কখনও ভারী বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে। এ বছরও ডুবেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলেন স্থানীয় বাসিন্দা আরমান হোসেন।
তার ক্ষোভের কারণ, সিলেট শহরজুড়ে গত ১৪ বছর ধরে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কারের কাজ চলছে। বিপুল অর্থব্যয়ের পরও সেই পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা কাজে লাগছে না। ভারী বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে এ শহর।
সিলেটে এ বছরের জলাবদ্ধতার চিত্র হচ্ছে, আগের সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর এটি স্থল নিম্নচাপ হয়ে সিলেট এলাকার ওপর দিয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে ভারতের আসাম চলে যায়, তখন পুরো সিলেট অঞ্চল ও আসামজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। আসাম থেকে অপেক্ষাকৃত নিচু সিলেট ও আশপাশের জেলাগুলোতে সেই ঢলের পানি নেমে আসে। ফলে সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জের হাওর ও অন্য নিচু এলাকাগুলো তলিয়ে যায়। সেই পানি পড়ে সরে আসে আরও উজানে সিলেট শহরে। প্লাবিত হয় সিলেট শহর। তবে এই জলাবদ্ধতা কাটার আগেই গত রোববার থেকে সোমবার পর্যন্ত টানা ২৪ ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে পুরোপুরি ডুবে যায় সিলেট মহানগর। বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরের শতাধিক এলাকা। পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে। এমনকি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও পানি ঢুকে পড়ে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকার কাজ করেছে সিটি করপোরেশন। এর বাইরে চলতি বছর তিনটি ড্রেন নির্মাণে খরচ হয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি আরও ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। সম্প্রতি ৩০০ কোটি টাকার আরও কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন হয়।
এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরমা নদীর নগর অংশ খননে গত দেড় বছরে খরচ করছে ৫৫ কোটি টাকা।
এত টাকা ব্যয় করার পরও কেন ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট নগর- এমন প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা আর পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির এ জন্য দায়ী করছেন অপরিকল্পিত উন্নয়নকে। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপক কাজ করা হয়েছে। বছরের পর বছর নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। কিন্তু এসব হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। নগরের ছড়া খাল ও দিঘি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। বড় বড় ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি সড়ক থেকে ড্রেনে নামার মতো যথেষ্ট জায়গা নেই। পানি নামার জন্য ড্রেনে কিছু গর্ত রাখা হলেও তা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে পারছে না।
সিলেট সিটি করপোরেশন বলছে, সুরমা নদী পানিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নগরের বৃষ্টির পানি নামতে পারেনি। এ কারণে জলমগ্ন হয়ে পড়ে নগরী।
তবে তা মানতে নারাজ নগরের বাসিন্দারা। নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রিপন চৌধুরী বলেন, রোববার ও সোমবার সিলেটে যে পানি হয়েছে এটা বন্যা নয়, এটা জলাবদ্ধতা।
তিনি বলেন, নদী ভরাট হওয়ার কারণে পানি জমলে সকালের পানি দুপুরে কমে যায় কী করে। এই নদী দিয়েই তো পানি নেমেছে। আসলে ড্রেন ভরাট হয়ে যাওয়া, সড়কের পানি নামার রাস্তা না থাকার কারণে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সিলেট নগর ঘুরে দেখা যায়, নগরের উপশহর, তেরররন, যতরপুর, মেন্দিবাগ, জামতলা, তালতলা, শেখঘাট, কলাপাড়া মজুমদার পাড়া লালদীঘির পাড়, সোবহানী ঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, কদমতলী, কালিঘাট, শেখঘাটসহ অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তবে মঙ্গলবার বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে যায়। যদিও উপশহর, তেররতন, তালতলাসহ কিছু এলাকায় এখনো পানি রয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ছড়া খনন, ছড়ার পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, ইউটাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নালা-নর্দমা প্রশস্তকরণসহ জলাবদ্ধতা নিরসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। চলতি বছর একই খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরও প্রায় ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে।
এর বাইরে নগরে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ১৫টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩০০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প সম্প্রতি অনুমোদন হয়। টাকা বরাদ্দ পেলেই এ কাজ দ্রুততার সঙ্গে শুরু হবে।
এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহুমদ চৌধুরী বলেন, সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো। সরকার বরাদ্দ দিলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয়নি। এসব টাকায় কী কী কাজ হয়েছে তা নগরবাসীর কাছে প্রকাশ করা দরকার।
তবে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অনেক সুফল মিলছে দাবি করে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, এখন আর আগের মতো জলাবদ্ধতা হয় না। তাছাড়া পানি জমলেও বৃষ্টি থামলে তা দ্রুত নেমে যায়।
রবি ও সোমবারের জলাবদ্ধতাকে ব্যতিক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি হয়েছে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে। বন্যায় সবগুলো ড্রেন ও ছড়া আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। নদীও পানিতে টুইটুম্বুর। তাই বৃষ্টির পানি জমে গেছে। আমরা ড্রেন ও ছড়া পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছি। এক্ষেত্রে নগরব্সাীকেও সচেতন হতে হবে। ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, ড্রেনে কিছুতেই ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে সুরমা নদী খনন ও শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। এ নিয়ে সিটি করপোরেশন কাজ করছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা