খুদে বাঘ কাঁদছে, তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে কাঁদছেন তার বাবাও। কেইবা কাকে সান্ত্বনা দেবেন! টিভিতে এক মুহূর্তের জন্য দেখা গিয়েছিল ব্যাঘ্র পরিবার হয়ে খেলা দেখতে আসা বাংলাদেশি সমর্থকদের। ওইটুকুই যথেষ্ট মনে দাগ রেখে যাওয়ার জন্য। কষ্ট ভুলতে যাবেন, তারও উপায় নেই। ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক জ্যারড কিম্বার এরই মধ্যে টুইট করে বসেছেন, ‘ক্রন্দনরত বাংলাদেশি বাঘ পরিবার আমার মনে বড় দাগা দিল।’
শুধু বাবা-কন্যার চোখে জল এমন নয়। ডাগ আউটে দাঁড়ানো তাসকিন আহমেদের চোখ ছলছল, বিবর্ণ শরিফুল ইসলামের মুখ। অ্যাডিলেড ওভালের স্কোরবোর্ডে ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে, ডিএল পদ্ধতিতে ভারত ৫ রানে জয়ী। নাটকীয় ম্যাচে আবারও আফসোস জাগানো, হতাশা বাড়ানো এক হার বাংলাদেশের।
তবু আফসোস লুকিয়ে ম্যাচ শেষে পেশাদারত্বকেই প্রাধান্য দিলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, ‘ভারতের বিপক্ষে সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা হচ্ছে না। আমরা জিততে পারিনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে। আমি খুবই খুশি এবং গর্বিত সবাই যেভাবে চেষ্টা করেছে মাঠে। তবে এটি ঠিক, খুবই ভালো একটি ম্যাচ ছিল। দর্শকরা উপভোগ করেছেন, দুই দল উপভোগ করেছে। আমরা এটিই চাই।’
১৬ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পার করা সাকিব বহুবার হারের যন্ত্রণায় চোখ মুখেছেন। বাস্তবতায় বাস করা সাকিব ভারতের মুখোমুখি হওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে তাই নিজের দলের ওপর থেকে চাপ সরাতে প্রতিপক্ষকে দিয়েছিলেন ফেবারিটের তকমা। সাকিবের ভাষায়, বাংলাদেশের জয় হতো দুর্ঘটনা।
শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারেননি সাকিবরা। তবে চেষ্টার কমতি ছিল না টিম ম্যানেজমেন্ট ও অধিনায়কের। প্রথা ভেঙে একাদশে চার পেসার, টি-টোয়েন্টিতেও তিন স্লিপ, দলের সেরা বোলার তাসকিন আহমেদকে টানা ৪ ওভার করিয়ে শুরুতেই স্পেল শেষ করানো তো সে বার্তাই দিয়েছে।
১৮৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে দারুণ শুরু পেয়েছিল বাংলাদেশ। সৌম্য সরকার না থাকায় ‘প্রিয়’ জায়গা ওপেনিংয়ে নেমে আগ্রাসী লিটন দাসের ব্যাট। পাওয়ার প্লেতেই ব্যক্তিগত ফিফটি তুলে নেন দলের সেরা ব্যাটসম্যান। আরেক ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্ত তখন ১১ বল খেলে বসে আছেন ৩ রানে। ৭ ওভারে ৬৬ রান তুলতেই অ্যাডিলেডের আকাশ ভরে বৃষ্টি। কিম্বারের দুষ্টুমিভরা টুইট, ‘ছক্কা মেরে বৃষ্টি নামিয়ে এনেছেন লিটন।’ সে বৃষ্টি না থামলে ডিএল পদ্ধতিতে ১৭ রানে এগিয়ে পূর্ণ ২ পয়েন্ট পেত বাংলাদেশ।
তবে প্রকৃতি সে সমীকরণ মেলাতে দেয়নি। বৃষ্টি থাকলে নতুন লক্ষ্যে ১৬ ওভারে করতে হবে ১৫১ রান, অর্থাৎ ৫৪ বলে প্রয়োজন আরও ৮৫ রান। ৭৯ রান করেই থামে বাংলাদেশ। ৫ রানে হারের জন্য বৃষ্টিকে দুষলেন সাকিব, ‘বৃষ্টির পর আমরা মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলেছি। তবে বৃষ্টি তো আমাদের হাতে নেই। যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে উইকেট একটু পিচ্ছিল ছিল।’
বৃষ্টি মোমেন্টাম নষ্ট করলেও সমীকরণ ছিল নাগালের মধ্যে। ২৬ বলে ৫৯ রানে ব্যাটিং শুরু করা লিটন ১ রান যোগ করে রান আউট হলে হাতে ছিল ৯ উইকেট। তবে আফসোস বাড়িয়েছেন শান্ত। তার ২৫ বলে ২১ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। ৫ ওভারে ৫২ রান, ৮ ব্যাটসম্যান হাতে রেখেও হার। সাকিব, আফিফ, মোসাদ্দেক, ইয়াসিররা চাপের কাছে নতজানু। তাতে উল্টো বেড়েছে চাপ।
সপ্তম উইকেট জুটিতে শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন নুরুল হাসান সোহান ও তাসকিন আহমেদ। তাদের ১৯ বলে ৩৭ রানের জুটি জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। শেষ ২ বলে ১১ রান প্রয়োজন হলে ৫ রানের বেশি তুলতে পারেননি সোহান। তার ১৪ বলে ২৫ ও তাসকিনের ৭ বলে ১২ রানের অপরাজিত ইনিংস দুটি তাই আক্ষেপ বাড়িয়েছে।
হারের ধরন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নিরাশ নন সাকিব, ‘যে অবস্থায় আমরা ছিলাম কোনো রানই কঠিন মনে হচ্ছিল না। আমরা জিততে পারিনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে। আমি খুবই খুশি এবং গর্বিত সবাই যেভাবে চেষ্টা করেছে।’ সাত চার ও তিন ছয়ে ২২২ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা লিটনকে প্রশংসা বন্যায় ভাসিয়ে বলেন, ‘দারুণ ফর্মে আছে। সে এই মুহূর্তে আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান। যেভাবে সে প্রথম ৬ ওভারে ব্যাট করেছে, সেটি আমাদের ইনিংসে মোমেন্টাম এনে দিয়েছিল।’
তবে পাঁচ বোলার নিয়ে খেলার সুবিধাটা কাল সে অর্থে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। চতুর্থ পেসার হিসেবে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে নামা শরিফুল দিয়েছেন ৫৭ রান। হাসান মাহমুদও ছিলেন খরুচে। যদিও বোলিংয়ের শুরুটা মন্দ হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের চতুর্থ ওভারে ২ রানে রোহিত শর্মাকে ফেরান হাসান। পাওয়ার প্লেতে ৩৭ রানের বেশি তুলতে পারেনি ভারত।
লোকেশ রাহুলের ৩২ বলে ৫০ ও বিরাট কোহলির ৪৪ বলে অপরাজিত ৬৪ রানের ইনিংস ভারতকে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি এনে দেয়। ১৬ বলে ৩০ রান করা সূর্যকুমার উত্তাপে পানি ঢালেন সাকিব। হার্দিক পান্ডিয়া, দীনেশ কার্তিক, অক্ষর প্যাটেলরা দুই অঙ্ক ছুঁতে না পারলে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৮৪ রানে থামে ভারতের ইনিংস। তবে শেষ দিকে অশ্বিনের ৬ বলের ১৩ রান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাচ হারলেও বোলারদের আগলে রাখলেন সাকিব, ‘খেলতে খেলতে শিখবে সবাই। প্রতি ম্যাচেই কেউ না কেউ ভালো করবে, কেউ না কেউ খারাপ করবে। কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে নিয়ে মন্তব্য করতে আমি কখনোই পছন্দ করি না।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা