রাজধানীর বিভিন্ন উন্মুক্ত পার্কে কফি শপ, ফুড ভ্যানে খাবার বিক্রি করার জন্য ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। চাকাযুক্ত ভ্যানে কফি শপের ইজারা দিলেও সেখানে বানানো হয়েছে স্থায়ী কাঠামো। আর ঠিকাদাররা কফি শপ বা ফুড ভ্যানের ইজারা নিয়ে পার্কেই বিক্রি করছেন বিরিয়ানি, ফাস্টফুড, কাবাবজাতীয় খাবার।
সরেজমিন দেখা গেছে, পার্কে হাঁটার পথ দখল করে থরে থরে সাজানো আছে টেবিল-চেয়ার। সেখানে চলে খাবার পরিবেশন, সিলিন্ডার গ্যাসে চলে রান্না। এ কারণে নষ্ট হচ্ছে পার্কের পরিবেশ। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বাসাবো খেলার মাঠ, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিকাটুলী পার্ক, গুলিস্তান পার্ক (বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান পার্ক), নবাব সিরাজউদ্দৌলা পার্ক, বংশাল পার্ক, শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ ও জোড়পুকুর খেলার মাঠ, বাহাদুর শাহ পার্ক, রসুলবাগ শিশুপার্কসহ সব মিলিয়ে নয়টি পার্ক ও খেলার মাঠে কফি হাউস ও ফুড কোর্টের জন্য ইজারা দিয়েছে ডিএসসিসি।
‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয়। ১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ ও পার্কগুলোর নবরূপের নকশা প্রণয়নের কাজে নামেন ৭০ জন স্থপতি। এর মধ্যে কয়েকটি পার্কের কাজ শেষ করে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে জনসাধারণের জন্য। সেগুলোতেই শর্তসাপেক্ষে কফি শপের ইজারা দেয় ডিএসসিসি।
কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে এসব পার্কে বাণিজ্যিক দোকান পরিচালনা করছেন ঠিকাদাররা। ইজারা শর্তে বলা আছে, মাঠের রাস্তা ও দেয়ালের ক্ষতি না করা, পার্কের ভেতর ময়লা-আবর্জনা না ফেলা, ইজারাদারকে নিজ খরচে নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক দ্রব্যাদির ব্যবস্থা রাখা ও কোনো প্রকার মাদকদ্রব্য, বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে বা বাণিজ্য করতে পারবেন না। সর্বোপরি জনসাধারণের কোনো অসুবিধার কারণ ঘটানো যাবে না। এসব শর্তের বরখেলাপ হলে ইজারা বাতিলসহ ইজারাদারের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে সিটি করপোরেশন। কিন্তু ইজারাদাররা এসব শর্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করছেন পার্কগুলোকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, পার্কের পরিবর্তে এখন বিরিয়ানি ও ফাস্টফুডের দোকান হয়ে গেছে। এসব কারণে পার্কে হাঁটাহাঁটি করে শান্তি নেই। শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে না। মনভরে নিশ্বাস নেয়া যায় না খাবারের গন্ধে।
পার্কে-মাঠে এসব বাণিজ্যিক দোকান স্থাপন নিয়ে ক্ষুব্ধ জনপ্রতিনিধিরাও। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবু সাঈদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকার বংশাল পার্কটি হাঁটার জন্য বানানো হলেও এখন সেটি বিরিয়ানি হাউস। সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘পার্কে কফি শপ তৈরি করা খুবই অস্বাভাবিক। মানুষ পার্কে যায় খোলা বাতাস নিতে, কফি খাওয়ার জন্য না। কফি খাওয়ার জন্য ঢাকা শহরে অনেক জায়গা আছে। ইজারাদাররা ইজারা নেন তাদের লাভের জন্য। এটি সিটি করপোরেশনের দেখা উচিত, তারা তাদের সঠিক কাজটি করছে কি না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সর্বসাধারণের জন্য তৈরি এসব ছোট পার্কে দোকান বসানোর কোনো মানেই হয় না। এসব দোকান পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক মো. খায়রুল বাকের দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে এখনো কিছু জানি না। আমরা তৈরি করার পর ইজারা দেয় সম্পত্তি বিভাগ। পরবর্তী যা করার সব করে সম্পত্তি বিভাগ। কেউ যদি শর্ত ভঙ্গ করে তাহলে তার ইজারা বাতিল করা হবে।’
ঢাকা শহরে কফি খাওয়ার জন্য এত জায়গা থাকতে পার্কে বা মাঠে কফি শপ কেন জানতে চাইলে ডিএসসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন যুক্তিসংগত কোনো উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘যখন ডিজাইন করা হয়েছিল, তখনই পার্ক ও মাঠের সঙ্গে পাবলিক টয়লেট ও কফি শপ রাখা হয়েছিল। কারণ পার্কগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা তা ইজারাদারের মাধ্যমে করা হবে।’ শর্ত ভঙ্গ করে পার্কে ভ্রাম্যমাণ স্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের ইজারা বাতিল করা হবে। পার্কে শুধু ভ্রাম্যমাণ কফি শপের ইজারা দেয়া হয়েছে। তারা কফি শপ পরিচালনার সঙ্গে পার্কটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর দেখভাল করবেন। সেখানে কোনো স্থায়ী কাঠামো, ওয়াকওয়ের জায়গা দখল করে ক্রেতাদের বসার জায়গা ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়নি।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা