আপডেট : ৩ নভেম্বর, ২০২২ ০৯:২৫
খালেদ আওয়ামী লীগের পক্ষে অভ্যুত্থান করেননি
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

খালেদ আওয়ামী লীগের পক্ষে অভ্যুত্থান করেননি

লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করেন মোশতাক-খুনি চক্রের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ

রাহাত মিনহাজ: সরাসরি আলোচনায় আসতে চাই। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর কীভাবে সূত্রপাত হলো। আপনার মতে এর প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

মহিউদ্দিন আহমদ: ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই কিন্তু ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গ চলে আসবে। যদি আমরা সেনা মনস্তত্ত্ব বিচার করি, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতর একটি দ্বন্দ্ব ছিল শুরু থেকেই। সেটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। আরেকটি ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন কমান্ডারের দ্বন্দ্ব। তার প্রকাশ আমরা দেখি ১৯৭৫ এবং এর পরবর্তী অবস্থায়।

১৫ আগস্ট যে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলো, সেটি করল একটি গ্রুপ। কিন্তু পুরো সেনা নেতৃত্ব সেটিকে অনুমোদন করল। পরে ৩ নভেম্বর যে অভ্যুত্থানটি হলো, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভ্যুত্থানকারীরা দুটি জিনিস বলেছিল। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা, বঙ্গভবনে বসে কয়েকজন মেজর-ক্যাপ্টেন ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনে কমান্ড প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃতপক্ষে অভ্যুত্থান ঘটায় ৪৬ ব্রিগেড। যদিও খালেদ মোশাররফের নামটি সামনে এসেছে। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়েত জামিল এবং ব্রিগেড মেজর ছিলেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ। আমি বলব এই দুজন ছিলেন মূল সংগঠক। আর ৪৬ ব্রিগেডের অন্যান্য কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফকে নিয়ে এগোতে চাননি। তারা চেয়েছিলেন চেইন অব কমান্ডের মধ্য দিয়েই যেতেই। তারা চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানকে বারবার বলেছেন যে ‘লেটস ডু সামথিং, এরা বেশি বাড়াবাড়ি করছে।’ জিয়া ছিলেন অনেকটা দোদুল্যমান। তারপর তারা অনেককেই বলেছিলেন, এদের আর্মি থেকে সরাতে হবে। জিয়া সবাইকে সরাতে রাজি হননি। তারপর জিয়া বলেছেন, ‘ঠিক আছে, তোমাদের সঙ্গে আমি একমত। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’ শাফায়েত জামিলদের তো আর তর সয় না। তারা শিগগিরই কিছু একটি করতে চান। তিনি যখন তার প্ল্যানটি খালেদ মোশাররফকে বললেন, খালেদ মোশাররফ এটি লুফে নিলেন।

খালেদ মোশাররফের সঙ্গে জিয়ার একটি দ্বন্দ্ব ছিল অনেক আগে থেকেই। তারা দুজনই সেনাপ্রধান হতে চান। মাঝখানে বাগড়া দিলেন কে এম সফিউল্লাহ। বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাপ্রধান করলেন। জিয়া হতাশ হলেন। খালেদও হতাশ হলেন। ১৯৭৫-এর জুনে যখন চিফ অব স্টাফের টার্ম শেষ হয়ে যায়, তখন জিয়া, খালেদ উভয়েই ভেবেছিলেন তারাই সেনাপ্রধান হবেন। দুজনের একজন। কিন্তু সেটিও হয়নি। সফিউল্লাহ সাহেবকে দ্বিতীয় মেয়াদে সেনাপ্রধান করা হয়। তাই দুজনই হতাশ হন। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে সফিউল্লাহকে সরিয়ে দেয়া হয়। জিয়া ও খালেদ মোশাররফ দুজনই ১৫ আগস্টের ঘটনাকে এনডোর্স করেছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর যে পুরো কর্তৃত্ব, সেটি তখনো কিন্তু প্রতিষ্ঠা হয়নি। তখনো বলা যায়, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। পার্থক্যটি হলো, এই সরকারে শেখ মুজিব নেই। মুজিববিহীন আওয়ামী লীগ। নেতা হচ্ছেন খন্দকার মোশতাক। আর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সরকারে নেই। বাকি সবাই আছেন। আগের মতোই সব আছে। তখন যদিও সামরিক আইন জারি হয়েছে। কিন্তু সামরিক আইনের সে রকম প্রয়োগ আমরা দেখিনি। কোনো সামরিক আইন প্রশাসক নেই। সেপ্টেম্বরে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বাকশালের যে বিধান ছিল, সেটি নিষ্ক্রিয় করা হয়। এটিই পরবর্তী সময়ে বিএনপি দাবি করে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি অসত্য। বহুদলীয় রাজনীতি যে কারণে বন্ধ ছিল, সংবিধানের সে ধারাটি সেপ্টেম্বরে রহিত করেন খন্দকার মোশতাক।

আমি যেটি বলতে চাচ্ছি, ৪৬ ব্রিগেড খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে। খালেদ তাতে রাজি হন। এ রকম একটি মুভ যে হচ্ছে, এটি কিন্তু জিয়া জানতেন। যেহেতু তাকে আগেই অ্যাপ্রোচ করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়া নিজে কোনো উদ্যোগ নেননি।

রাহাত মিনহাজ: এই অভ্যুত্থানের প্রথম দিকে কী কী ঘটনা ঘটল। কী ধরনের পরিবর্তন এল রাষ্ট্রকাঠামো বা রাষ্ট্রক্ষমতায়?

মহিউদ্দিন আহমদ: যখন ৩ নভেম্বর ভোরে এই অভ্যুত্থানটি ঘটে গেল, ওই সময় জেলখানায় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। জেলখানায় আমাদের যে জাতীয় চার নেতা আছেন, তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। মজার ব্যাপার হলো এই যে যারা চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করার কথা বললেন, তারা কিন্তু প্রথমেই চেইন অব কমান্ডটি ভাঙলেন। অর্থাৎ তারা সেনাপ্রধান জিয়াকে অন্তরীণ করলেন। তার কাছ থেকে একটি পদত্যাগপত্র আদায় করলেন। তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বহাল রেখে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার জন্য লবি করতে শুরু করলেন। ১৫ আগস্টের যারা কুশীলব ছিলেন, তাদের নিরাপদে দেশত্যাগ করার সুযোগ করে দিলেন।

রাহাত মিনহাজ: ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের ভেতরেই জেল হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড নিয়েও রহস্যের শেষ নেই। জেলখানার সুরক্ষিত স্থানে তাদের হত্যা করা হলো। অভ্যুত্থানকারীরা দাবি করেন, তারা এই বিষয়টি পরে জানতে পারেন। আসলে রহস্যটি কী?

মহিউদ্দিন আহমদ: শাফায়েত জামিলের ভাষ্য অনুযায়ী ৪ নভেম্বর তারা জানতে পারলেন জেলখানায় চারজন নিহত হয়েছেন। এটি খুবই আশ্চর্য লাগে। কারণ ৩ নভেম্বর দিবাগত রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে তারা অভ্যুত্থানটি করলেন। ওই সময়েই হত্যাকাণ্ডটি হলো। এটি কেউ টের পেলেন না, কেউ জানলেন না! জেলখানায় কিন্তু কেউ ট্যাংক কামান নিয়ে যায়নি। যে গল্পটি আমরা জানি, খন্দকার মোশতাক টেলিফোন করলেন। তার নির্দেশ শুনে জেলের গেট খুলে দেয়া হলো। তারা কয়েকজন ভেতরে গিয়ে চারজনকে মেরে চলে আসেন। এই বয়ানটি আমরা বছরের পর বছর শুনছি। আমরা কেউ প্রশ্ন করি না, তোমরা জেল গেটটি খুললে কেন? ওরা কি ট্যাংক নিয়ে এসেছিল? দ্বিতীয় ব্যাপারটি হলো ৪ তারিখ সকাল পর্যন্ত ৩ তারিখের অভ্যুত্থানকারীরা জানতে পারল না যে জেলখানায় এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে? তাদের মনের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র একটা ইচ্ছা থাকত যে তারা ১৫ আগস্টের বদলা নিচ্ছেন এমন কিছু। একটি রাজনৈতিক সরকারে ফিরে যাওয়া, সেটিই যদি তাদের পরিকল্পনায় থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তারা তাদের প্ল্যানের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে রাখতেন। তারা তো তাদের প্ল্যানের মধ্যে এই চার নেতাকে রাখেননি। তারা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি রেখেই খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান করতে চেয়েছিলেন। তাদের প্রথমেই উচিত ছিল খন্দকার মোশতাককে গ্রেপ্তার করা, তার সাঙ্গপাঙ্গদের গ্রেপ্তার করা। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বসিয়ে দেয়া। তারা সেটি করেননি। ৪ নভেম্বর যখন তারা খবর পেলেন বলে দাবি করছেন যে এই চার নেতা জীবিত নেই। তারা তখন কী করতে পারতেন? একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হলে কী করতে হতো? আমাদের সংবিধানে যা আছে, রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। স্পিকার আবদুল মালেক উকিল তো তখন ছিলেন। কিন্তু তারা কী বললেন? খন্দকার মোশতাক যখন কোনোভাবেই খালেদ মোশাররফের শর্তে রাজি হচ্ছিলেন না, শেষমেশ তাকে দিয়ে একটি পদত্যাগপত্র সই করানো হলো। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হলো। মালেক উকিলকে নয়। তার মানে সংবিধানের ধারে কাছেও তারা গেলেন না। দ্বিতীয়ত, তারা আরেকটি কাণ্ড করলেন। তখন পার্লামেন্ট ছিল নামকাওয়াস্তে। এই পার্লামেন্টকে খালেদ মোশাররফ ৬ নভেম্বর সায়েমকে দিয়ে বাতিল করে দিলেন। মানে আর নেই। এই পার্লামেন্ট আগে বাতিল হয়নি। এমপিরা বঙ্গভবনে গিয়ে মিটিং করতেন। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক হতো বঙ্গভবনে। এবার পার্লামেন্ট বাতিল হলো। সায়েমকে তারা ঘোষণা করলেন চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। যেটি খন্দকার মোশতাক ছিলেন। তার মানে পুরোপুরি আইয়ুব-ইয়াহিয়া মডেলের সামরিক শাসন। একই সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান হলেন ডেপুটি চিফ মার্শাল ’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। অর্থাৎ ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল আধা সামরিক সরকার। মুজিববিহীন আওয়ামী লীগ সরকার। পেছনে সেনাবাহিনী। আর ৬ নভেম্বর থেকে আমরা দেখলাম পুরোপুরি সেনা সরকার। মিলিটারি গভর্নমেন্ট। অর্থাৎ যেখানে সেনাবাহিনীর মনোপলি কন্ট্রোলটি ছিল না সরকারের ওপর। কারণ খন্দকার মোশতাক, তার নিচে ডিফেন্স অ্যাডভাইজার ওসমানী, তার নিচে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ খলিলুর রহমান, তারপরে ফারুক রশিদের মতো মেজররা ছড়ি ঘোরাত। তারপর ছিল ক্যান্টনমেন্টের নেতৃত্ব। যারা একটু প্যারিফেরিতেই ছিলেন ওই সময়। এই পরিস্থিতিটি পাল্টে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া শুরু হলো ৪ নভেম্বরে। কিন্তু সেটি শেষ হয়নি। যেহেতু পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান হয়ে যায় ৬ নভেম্বর রাতে বা ৭ তারিখ ভোরে। পরিস্থিতিটি পাল্টে যায়।

রাহাত মিনহাজ: ১৫ আগস্ট যেমন রক্তপাত হয়েছে, সেই বিবেচনায় ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে কোনো রক্তপাত হয়নি। বলা যায় রক্তপাতহীন এক প্রচেষ্টা। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মহিউদ্দিন আহমদ: আপনার প্রথম প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি। এই অভ্যুত্থানটি রক্তপাতহীন হলো কেন? আমাদের যে পলিটিক্যাল লিগ্যাসি, আমরা যদি ১৯৪৭ থেকে শুরু করি, আমরা ১৯৭৫-এর আগে দুটি সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে গেছি। একটি আইয়ুব খানের, আরেকটি ইয়াহিয়া খানের। দুটি অভ্যুত্থানই রক্তপাতহীন। সুতরাং সামরিক অভ্যুত্থান হলেই বা সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলেই যে রক্তপাত হবে, এটি আমি মনে করি না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে আমরা ভয়াবহ, নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখলাম। এটি বলা যায় যে একটি পরিবারের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু, তার ভগ্নিপতি এবং ভাগনে এই তিনটি বাড়িতে হামলা হলো সেদিন। সেদিন ১৫ আগস্টে তারা চাইলে কেবল এই চার নেতা কেন, এমন আরও ৪০ নেতাকে হত্যা করতে পারত। অবশ্যই পারত। কোনো প্রতিবাদ তো আমরা দেখিনি। সেটি তারা করেনি। ১৫ আগস্টের কিন্তু একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। ৩ নভেম্বর সে রকম কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। এটি ছিল পুরোপুরি সেনা-কর্তৃত্ব। সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ সেখানে মাস্তানি করছে। তাদের খপ্পর থেকে এটি তারা উদ্ধার করে পুরো কর্তৃত্বটি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসবে। মূলত এটিই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ১৫ আগস্ট যারা করেছিল, তারা কোনো ফাঁক রাখেনি। তারা লক্ষ্য হাসিল করতে গিয়ে কোনো পিছপা হয়নি। কিন্তু ৩ নভেম্বর কিন্তু তাদের মধ্যে নানা রকমের দোদ্যুলতা ছিল। পুরো ৩ ও ৪ নভেম্বরজুড়ে শুধু বঙ্গভবনে তারা দেনদরবার করেছে খালেদকে সেনাপ্রধান বানানোর জন্য। তারা চাইলে অনেক কিছু করতে পারত ওই সময়। বঙ্গভবন তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কারণ ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা তো ৩ তারিখে চলে গেছে। তারা এটি করেনি। তার মানে, তাদের সে রকম কোনো লক্ষ্য ছিল না। তৃতীয়ত, সেনাবাহিনীতে তাদের কতটুকু সমর্থন আছে, সেটি নিয়েও তাদের মাঝে সন্দেহ ছিল। কারণ তারা এমন একজন সেনাপ্রধানকে অন্তরীণ করেছে, যিনি সেনাবাহিনীতে খুব জনপ্রিয়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য সেনাবাহিনীর বাইরেও জনপ্রিয়। তাকে সেনাবাহিনী থেকে অন্তরীণ করাটা পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য খুব বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

রাহাত মিনহাজ: অনেকেই বলে থাকেন এটি ছিল ভারতপন্থি একটি অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য।

মহিউদ্দিন আহমদ: এই অভ্যুত্থান ভারতের পক্ষের ছিল কি না- এটি কিন্তু আজকে আমরা ৪০-৫০ বছর পর এসে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। ওই সময়ের বাংলাদেশে একটি ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্ব ছিল। আর এই মনস্তত্ত্বটি আসমান থেকে আসেনি। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের যে ভূমিকা, পাকিস্তান আমলেও এ দেশের মানুষ ভারতবিরোধী ছিল। কেবল মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাকিস্তান বিরোধিতা। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান আর দৃশ্যপটে নেই। তখন আবার ভারত সামনে চলে এসেছে। অন্যদিকে বাকশাল সরকার বা আওয়ামী সরকারকে ভারতপন্থি সরকার হিসেবে দেখা হতো। এটি সবার জানা কথা। ওই সময়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি আর ভারতবিরোধী রাজনীতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখন ৩ নভেম্বর একটি অভ্যুত্থান হলো এবং এটি যখন জিয়া-মোশতাকের বিরুদ্ধে গেল। তাই জনমনে একটি ধারণা হতেই পারে এটি ভারতের পক্ষের অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগের পক্ষের অভ্যুত্থান। এই ধারণাটিও তৈরি হতো না, যদি আওয়ামী লীগাররা নড়েচড়ে না বসত। তারা ভাবল, তাদের পক্ষে অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। ৪ নভেম্বর তারা একটি বিশাল মিছিল বের করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এল বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে। এটির মূল আয়োজক ছিল সিপিবি। তখন সিপিবির ছাত্র ইউনিয়ন আর ছাত্রলীগ একসঙ্গে মিলে বাকশালের জাতীয় ছাত্রলীগ হয়ে গিয়েছিল। সিপিবি ছাত্রলীগের কাঁধে বন্দুক রেখে এই কাজটি করল। কলাবাগানের সামনে যখন মিছিলটি এল, তখন খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ এবং তার মা মিছিলে যুক্ত হলেন। সুতরাং মানুষ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে দেখল, এটি তো আওয়ামী লীগের পক্ষের অভ্যুত্থান। অতএব এটি ভারতপন্থি অভ্যুত্থান।

তবে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের পক্ষে বা আওয়ামী লীগকে সরকারে বসানোর জন্য অভ্যুত্থান করেছে, এটি আমি মনে করি না। করলে তো তারা জেল হত্যাকাণ্ডটি হতে দিত না। শাফায়েত জামিলরা ৩ নভেম্বর নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহীতা: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়