আপডেট : ৪ নভেম্বর, ২০২২ ০৯:০৪
সালাম মুসাফা মুয়ানাকায় ইসলামি রীতি-নীতি
ড. মোহাম্মদ হাননান

সালাম মুসাফা মুয়ানাকায় ইসলামি রীতি-নীতি

ছবি: সংগৃহীত

সালাম, মুসাফা এবং মুয়ানাকাকে মসুলমানদের আদব-কায়দায় গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ হিসেবে দেখা হয়। ‘সালাম’ আরবি শব্দ। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা। আবার শান্তি কামনা ও শুভেচ্ছা প্রকাশেও ‘সালাম’ প্রচলিত রয়েছে। অভিবাদন জানাতেও সালাম জানানো যায়। সালামের পুরো শব্দটি ‘আসসালামু আলাইকুম’, কেউ কারও উদ্দেশ্যে এ বাক্যটি বললে এর অর্থ হয় অনেকটা এ রকম: ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’। (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ২০১৫ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১১৪৯)।

আর মুসাফা হলো করমর্দন। এটাকে হস্তমর্দনও বলা হয়। পরস্পরের হাতে প্রীতিমূলক বিশেষ স্পর্শ, অনেকটা পাশ্চাত্য কায়দায় Handshake-এর মতো। কিন্তু Handshake ও মুসাফার মধ্যে পার্থক্য আছে। Handshake করার সময় পরস্পরের এক হাতই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মুসাফায় পরস্পরের দুই হাতের তালু এপিঠ-ওপিঠ করে একত্রে স্পর্শিত হবে। অর্থাৎ Handshake-এ যেখানে একহাত মেলানো হয়, মুসাফায় সেখানে দুই হাতের তালু মিলিত হয়।

‘মুয়ানাকা’য় পরস্পর পরস্পরকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরবে এবং বুকে বুক মিলাবে। অনেকটা আমাদের দেশে ঈদের দিনে যেভাবে ‘ঈদ মোবারক’, ‘কোলাকুলি’ নামে ‘বুকাবুকি’ হয়ে থাকে (যদিও এটা ঈদের বিশেষ কোনো আমল নয়)। মুয়ানাকা হয়, কারও সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে, আনন্দের আতিশয্যে একজন আরেকজনকে বুকের মধ্যে স্থাপন করে নেয়। কেউ কোনো কৃতিত্ব অর্জন করলেও মুয়ানাকা দ্বারা তাকে অভিনন্দিত করা হয়।

তবে সালাম, মুসাফা ও মুয়ানাকা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ সালাম করে, তখন তোমরা তা অপেক্ষা উত্তম শব্দ দ্বারা সালামের জবাব দাও।’ (সূরা নিসা, পৃষ্ঠা-৮৬)। সে জন্য কেউ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললে উত্তরে আরও উত্তম শব্দ প্রয়োগ করে বলতে হবে ‘ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রহমতুল্লাহে ওয়া বারকাতুল্লাহ’। অর্থাৎ শান্তির সঙ্গে আল্লাহ আপনাকে রহমত (দয়া) ও বরকত (কল্যাণ) দান করুন। এরূপ যে করবে সে ৩০টি অতিরিক্ত নেকি হাসিল করবে। (হাদিস শরিফ: আবু দাউদ)

হাদিস শরিফে আছে যখন কারও সঙ্গে দেখা হয়, তখন আগে সালাম দিতে হবে। (ইবনে মাজাহ) বোখারি শরিফে আছে, কেউ সালাম দিলে সেই সালামের জবাব দেয়া চাই। আলেমগণ বলেন, সালাম দেয়া সুন্নত, তবে সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ সালামের উত্তর না দিলে গুনাহ হবে।

নবী (সা.) তার সাহাবিদের একবার বলেন, যদি তোমরা একে ওপরের সঙ্গে মহব্বত ও ভালোবাসা পয়দা করতে চাও, তাহলে সালামের খুব প্রচলন কর। হাদিসটি মুসলিম শরিফের এবং তা আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।

আবু দারদা (রা.) থেকে এ বিষয়ে একটি হাদিস এসেছে, তা হলো, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সালামের খুব প্রসার কর। এটা করতে পারলে তোমরা উন্নত হয়ে যাবে।’ (হাদিস শরিফ তাবারানী)। আবার বাযযার, তারগিব কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.)-এর থেকে একটি হাদিস সংকলিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সালাম হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার অন্যতম একটি নাম। তোমরা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রসার কর।’

তবে যে আগে সালাম করবে, সে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। (আবু দাউদ শরিফ) তাই সমাজে সালাম নিয়ে যে বিভ্রান্তি আছে, তা দূর করতে হবে। বয়সে বড়রা মনে করে, ছোটরা তাদের আগে সালাম করবে, অফিসে বড়কর্তা মনে করে তার অধীনস্থরা তাকে আগে সালাম করবে, তিনি জবাব দেবেন। কিন্তু না, হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সালাম বড়-ছোটর কোনো বিষয় না। পিতা সন্তানকে সালাম দেবেন, স্বামী স্ত্রীকে সালাম দেবেন। বড়রা এভাবে ছোটদের সালাম দেবেন, অফিসের কর্তা তার অধিনস্থদের সালাম দেবেন। নবী (সা.) বলেছেন, যে আগে সালাম দেয়, সে অহঙ্কার থেকে মুক্ত। (হাদিস শরিফ: বায়হাকি)

ঘরে প্রবেশ করার সময় সালাম দেয়া ইসলামের আরেকটি রীতি। আবার যখন ঘর থেকে বের হয়ে যাবে তখন ঘরের লোকদের সালাম করে বের হয়ে যাবে। এটা ঘরের লোকদের জন্য বরকত ও কল্যাণ নিয়ে আসে (হাদিস শরিফ তিরমিযি এবং মুসন্নাফ আবদুর রাযযাক)। নবী (সা.) যখন ঘরে প্রবেশ করতেন তখন এতটা জোরে সালাম দিতেন না, যাতে ঘরে ঘুমন্ত কেউ থাকলে জেগে ওঠে। আবার যারা জেগে আছে তারা যেন শুনতে পায় (তিরমিযি)।

মজলিসে সালাম দেয়ারও আদব আছে। একটি মজলিস চলছে, তখন দেরিতে পৌঁছে আমি একটু জোরে সালাম দিয়ে দিলাম। এমনটি ঠিক নয়। এতে সব লোক মজলিস ছেড়ে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে ফেলবে। চলমান মজলিসের মনোযোগ অন্যত্র চলে গেল।

আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘খাওয়ার সময় সালাম দিতে নেই’। আসলে বিষয়টি এমন নয়, শুধু খাওয়ার সময় নয়, কেউ একটি কাজে গভীর মনোযোগে আছে, একজন কোরআন পড়ছে, এমন একটি অবস্থায় সালাম দেয়া জরুরি নয়। দেখতে হবে- যাকে সালাম দিচ্ছি, তিনি এর উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় আছেন কি না। যদি তখন মুখে খাবার না থাকে, সালাম দেয়া যাবে, কারণ তখন তিনি জবাব দিতে পারবেন। সালামের জবাব দেয়া জরুরি। জবাব না দিলে গুনাহ হবে। পবিত্র কোরআন পড়ার সময় কেউ যদি সালাম দিয়েই ফেলে, তা হলে কোরআন পড়া বন্ধ রেখে সালামের জবাব দেয়া চাই। কারণ কোরআন পড়া আল্লাহর হক, কিন্তু সালামের জবাব দেয়া বান্দার হক। আল্লাহ তা’আলা তার হক থেকে বান্দার হককে বড় করে দেখেছেন।

এমনিতে ইসলামি রেওয়াজ হলো, ছোট বড়কে আগে সালাম দেবে, চলমান ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে সালাম দেবে এবং কমসংখ্যক লোক বেশিসংখ্যক লোককে সালাম দেবে। এ নির্দেশনা এসেছে বোখারি শরিফ থেকে। তবে বসা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন এর জবাব দিলেই আদায় হয়ে যাবে।

আবু হোরায়রা (রা.) বলেছেন, তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছেন, মানুষের মধ্যে সবচাইতে কৃপণ ওই ব্যক্তি যে সালামের মধ্যেও কৃপণতা করে (হাদিস শরিফ: মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে কিছু লোক আছেন, যারা সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে অলসতা করেন, সালাম এড়িয়ে যেতে চান, তারা এই কৃপণ লোকদের অন্তর্ভুক্ত।

আমাদের সমাজে কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষতা দেখাতে অথবা নিজেকে প্রগতিশীল ভাবনার লোক হিসেবে পরিচিত করতে সালাম না দিয়ে বলতে থাকেন, ‘শুভেচ্ছা’, ‘শুভেচ্ছা’। প্রকৃতপক্ষে এগুলো হলো চিন্তা-চেতনার দৌর্বল্যের পরিচায়ক। আবার একদল বিদায়ের সময়ে ‘খোদা হাফেজ’ নামে একটি শব্দ প্রচলনের চেষ্টা করেছে। এর পাল্টা অন্যদল বিদায়ের সময়ে বলে ‘আল্লাহ হাফেজ’। বিদায়ের সময়ে এমন সম্বোধনের ইসলামি দলিল নেই। বরং তিরমিযি শরিফের হাদিস হলো, ‘সাক্ষাতের সময় যেমন সালাম করা সুন্নত, তেমনি বিদায়ের সময়েও সালাম করা সুন্নত। এর বিপরীতে অন্য সম্বোধন চালু করা মানে সুন্নত থেকে উম্মতকে সরিয়ে দেয়া।

সালাম দেয়ার সময় অনেকে মাথা নুয়ে ফেলে। কিন্তু মসুলমান আল্লাহ ছাড়া আর কোথাও মাথা নোয়াবে না। এটা হবে এক ধরনের ‍শিরক বা অংশীবাদিতা, আল্লাহ একেবারেই এটা পছন্দ করেন না। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও অবিশ্বাসীদের অভিবাদনের তুলনায় মুসলিমদের সালামে এভাবে ভিন্নমাত্রা প্রবাহিত।

সালাম যখন করবেন তখন আপনা-আপনি মুসাফা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) বলেন, রাসুল পাক (সা.) বলেছেন, সালামের পূর্ণতা ঘটে মুসাফায় (তিরমিযি)। যারা নবী (সা.) থেকে শুনে বলেছেন, দুজন মুসলিম যখন পরস্পর মিলিত হয় এবং মুসাফা করে, তখন পৃথক হওয়ার পূর্বেই তাদের উভয়ের গুনাহকে মাফ করে দেয়া হয় (আবু দাউদ শরিফ)।

অন্যত্র আরও আছে, মুমিন যখন মুমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাকে সালাম করে এবং তার হাত ধরে মুসাফা করে, তখন উভয়ের গুনাহ এমনভাবে ঝরে যায়, যেমন গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে (তাবারানী)।

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যদিও তাদের গুনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়’ (মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)।

অনেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে সাহাবিরা এ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে রাসুল (সা.) তাদের সঙ্গে মুয়ানাকা করেছেন। আবু যার (রা.)-এর বর্ণিত একটি হাদিস আবু দাউদ শরিফে সংকলিত হয়েছে, যেখানে তার সঙ্গে নবী (সা.) জড়িয়ে ধরে মুয়ানাকা করার কথা উল্লিখিত হয়েছে।

পাদটিকা

সালাম হতে হবে স্পষ্ট ও শুদ্ধ। ‘আসসালামু আলাইকুম’-এ হলো শুদ্ধ উচ্চারণের সালাম। অনেকেই বিকৃত করে সালাম দেন, বলেন- ‘সালাইমালাইকা’। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানেও (জামিল চৌধুরী সম্পাদিত) ২০১৮ সংস্করণে আছে, ‘সালাম আলায়কুম’। বস্তুত এটা হলো বিকৃত এবং হাস্যকর অভিবাদন, যার কোনো অর্থও হয় না।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও গবেষক।