উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর একনাগাড়ে বৃষ্টিতে এক মাসের মধ্যে তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট অঞ্চল। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার সীমান্তবর্তী চার উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। ঢল অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে, টানা বৃষ্টিতে সিলেট নগরেরও অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, একই কারণে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিম্নাঞ্চল এবং তিস্তা ও ধরলায় নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই হওয়ায় প্লাবিত হয়েছে লালমনিরহাট-রংপুর ও কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়া টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে খরস্রোতা মাইনি এবং চেঙ্গি নদী পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় মিলে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সিলেট ব্যুরো থেকে দেবাশীষ দেবু জানান, সিলেটে গত ২৭ মে আগাম বন্যা দেখা দেয়। দুই সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যা হয় সিলেটে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার দিন ভোর থেকে অতিভারী বর্ষণে তলিয়ে যায় সিলেট নগরসহ জেলার বেশির ভাগ এলাকা। এই বন্যার পানি ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে সিলেটের সব উপজেলার অন্তত ১৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। তবে গত সপ্তাহ থেকে নামতে শুরু করে দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি।
তবে দ্বিতীয় দফা বন্যার পানি পুরো নামার আগে গত সোমবার থেকে সিলেটে ফের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢলে কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। টানা তিনদফা বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এসব এাকার বাসিন্দারা। তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। অনেকের ঘরবাড়িতেও পানি ঢুকে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সিলেটে ৫টি নদীর পানি ৬টি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ২২ সেন্টিমিটার ও কুশিয়ারা পয়েন্টে ০.৭ সেন্টিমিটার এবং সারিগোয়াইন নদীর পানি গোয়াইনঘাট পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, মূলত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টির কারণে সিলেটে আবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ৪৮ ঘণ্টায় ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
তিনি বলেন, আগে থেকেই সিলেটের নদনদী ও হাওর পানিতে ভরাট হয়ে আছে। ফলে নতুন করে বৃষ্টিতে ঢলের পানি নামতে পারছে না। এ কারণে দ্রুত লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।
কানাইঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে ঢলে কানাইঘাটে সুরমা ও লোভা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ফলে আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা ডাইকের অন্তত ১৮টি স্থান দিয়ে সুরমা ও লোভা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার জনপদ ফের বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
তৃতীয় দফা বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা, দরবস্ত, ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এসব এলাকায় অনেকেই নতুন করে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, তৃতীয় দফায় ভারী বর্ষণে জৈন্তাপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আগের আকার ধারণ করেছে। উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, যেসব ঘর-বাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের সময় নষ্ট না করে এখনই নিরাপদ আশ্রয়ে কিংবা নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে।
এদিকে, সোমবার থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে রাতে সিলেট নগরের অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত জলমগ্ন ছিল নগরের অন্তত ২৫টি এলাকা। এতে ভোগান্তিতে পড়েন এসব এলাকার বাসিন্দারা। তবে দুপুরে বৃষ্টি থামার পর পানি নামতে শুরু করে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে কিছু এলাকায় পানি জমেছিল। তবে বৃষ্টির থামার পর পানি নেমে গেছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বৃষ্টির পানি যাতে না জমে, সে জন্য কাজ করছেন।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে এর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলা সদরের যাত্রাপুর ও উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। বাড়ছে ধরলা ও দুধকুমার নদের পানি।
এ অবস্থায় এসব নদ-নদীর নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পাউবো বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, দেশের উত্তরাঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দুধকুমার, ধরলা ও তিস্তা নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পেয়ে কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রমের পথে। এতে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
পাউবো কুড়িগ্রামের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার অববাহিকার পাটেশ্বরী পয়েন্টে ১৪১ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে ধরলার পানি কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ৪৯ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ব্রহ্মপুত্রে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে এর নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে চলছে তীব্র ভাঙন। উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চর বালাডোবা, বতুয়াতলি মুসার চর, ব্যাপারীপাড়া নতুন চর এবং পূর্ব ও পশ্চিম মশালের চরের অর্ধশতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। বাধ্য হয়ে এসব পরিবারের অনেকে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন। ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী মোল্লাহাট বাজার এলাকায় শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। বাজার রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতিতে পানিবন্দি পরিবারে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। এ ছাড়া দুর্গত পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’
এদিকে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে যাত্রাপুরের রলাকাটা চরে একের পর এক বসতভিটা বিলীন হচ্ছে। চরের উত্তর দিকে অব্যাহত ভাঙনে গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা বেলাল বলেন, ‘বন্যার পানি এখনও বাড়িঘরে প্রবেশ করে নাই। তবে ভাঙনে এলাকার মানুষ দিশেহারা। রলাকাটার পশ্চিমে মাঝের চর ও চিড়াখাওয়ার চরের আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বাড়তে থাকলে দু-এক দিনের মধ্যে বাড়িঘরে ঢুকবে।’
যাত্রাপুরের কালির আলগা ও গোয়াইলপুরির চরে গত দুই দিনে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেখানকার বেশ কিছু পরিবারের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ পরিবারের বসতবাড়ির চারপাশে পানি।
গোয়াইলপুরির চরের বাসিন্দা মাহবুব বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ। বন্যার কবলে পইড়া গেছি। ঘরবাড়িতে পানি ঢুকতাছে। আইজ-কাইলের মধ্যে সব ঘরবাড়িতে পানি ঢুইকা পড়ব।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা ত্রাণ সহায়তা বিতরণ অব্যাহত রেখেছি। জেলাজুড়ে চার শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আবারও পানি বৃদ্ধির ফলে যেসব এলাকা প্লাবিত হচ্ছে আমরা সেদিকে বাড়তি নজর রাখছি।’
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে খরস্রোতা মাইনি এবং চেঙ্গি নদী পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় মিলে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
মাইনি এবং চেঙ্গি নদী পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় লোকজন স্থানীয় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন।
হঠাৎ করে পানি উঠায় লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। অনেকেই গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে এসেছেন। পানি বৃদ্ধিতে শহরের একমাত্র পৌর বাস টার্মিনালটি পানিতে ডুবে যায়। যানবাহনগুলোকে উঁচু রাস্তায় সুরক্ষায় রাখা হয়েছে।
একইভাবে দীঘিনালার ১০টি গ্রাম পানির নিচে রয়েছে। এখানকার মেরুংবাজারটি পানির নিচে।
সাজেকে আটকা শতাধিক পর্যটক
রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের কারণে কাচাংল নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সাজেকের মাচালং বাজার, বাঘাইহাট এবং পার্শ্ববর্তী খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার কবাখালী এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সাজেকে শতাধিক পর্যটক আটকা পড়েছে।
এদিকে, সাজেকের কুঁড়েঘর রিসোর্টের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম জানান, রোববার থেকে ভারী বৃষ্টির ফলে কাচালং নদীতে পানি বৃদ্ধি হয়ে মাচালং ও বাঘাইহাটে রাস্তার ওপর পানি উঠে যাওয়ায় সাজেকের কয়েকশ পর্যটক আটকা পড়েছেন।
বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরীন আক্তার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, পাহাড়ি ঢলে কাচালং নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় সাজেকের আশপাশ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সড়কে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়েছে। যে কারণে সাজেক থেকে পর্যটকবাহী যানগুলো ছেড়ে যেতে পারেনি।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা