সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সব সেবার তথ্য একটি ইন্টার-অপারেবল প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রদানের সার্ভিস পোর্টালের কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এতে সহসা সেবা পেতে সহায়ক হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার জন্যই বিডা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিডা বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়াদি নিবিড় মনিটরিং করা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক দেশই বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে দেশের বিনিয়োগকারীদের ওপর যে রকম সেবা দেওয়া দরকার তার চেয়ে বেশি সেবা দিতে হয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। অবশ্যই এ সেবার ওপরই দেশের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। সেই সেবাটা কতটুকু পাচ্ছে দেশে তা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার চিত্র থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্ট অনুযায়ী (যা ২০ জুন ২০২৪ প্রকাশিত) বিগত বছরগুলোতে প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ২৫৬ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতি ও হ্রাস পেয়েছে বছরওয়ারি তথ্য অনুযায়ী- ২০১৯ সালে ১৭৭৮ কোটি ডলার, ২০২০ সালে ১৯৩৯ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ২১৫৮ কোটি ডলার, ২০২২ সালে ২০৭৫ কোটি ডলার, ২০২৩ সালে ২০৫৫ কোটি ডলার।
২০২৩ সালে এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। গত বছরের চেয়ে এ বছর ৪৮ কোটি ডলার কম সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কম হয়েছে। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই দেখা যাচ্ছে যে করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাবে এফডিআই প্রায় দেশেই হ্রাস পেয়েছিল। বাংলাদেশে ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছিল। মহামারি কাটিয়ে বিশ্বজুড়ে যখন স্বস্তি ফিরে আসে সব দেশেই বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ ও এফডিআই বেড়েছিল।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের ২০২৪-এর ২০ জুন প্রকাশিত বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে (WIR) আরও যেসব তথ্য উঠে এসেছে তা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে।
২০২৩ অনেক দেশের অর্থনৈতিক গতি হ্রাস পাওয়া ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্বজুড়ে মোট এফডিআই কমেছে সার্বিকভাবে ২ শতাংশ। এফডিআই পরিমাণগত দিক হলো ১.৩০ ট্রিলিয়ন ডলার। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ও ১৪% কমেছে। প্রতিবেদনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিগত তিন বছর (২০২০ থেকে ২০২২) পর্যন্ত এফডিআই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে উল্টোটা হলো।
বিনিয়োগের হ্রাসের কারণে এফডিআই বিনিয়োগ স্টক ব্যালেন্স ও (বিনিয়োগ স্থিতি) হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালে বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার ২০২৩ সালে স্থিতি ছিল ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে (এলডিসি) এফডিআই প্রাপ্তিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ। যদিও সামগ্রিকভাবে গত বছর এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় এফডিআই ১৭ শতাংশ বেড়েছিল সেখানে বাংলাদেশ উল্টো হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩ সালে তারপর ও যেসব দেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে আমাদের দেশে ভূমিকা রেখেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো (যা বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে প্রকাশিত)- নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছে বিনিয়োগ ৩৬৬ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার, চীন থেকে ২৫৯ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৮১ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার নরওয়ে থেকে ১৭৬ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার।
অবশ্য ৪৫টি এলডিসিভুক্ত দেশে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ পেয়েছে ৫টি দেশ। এর মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছে আমাদের বাংলাদেশ। গত বছর ও একই অবস্থান ছিল। শীর্ষ দুই দেশ হলো ইথোপিয়া ও কম্বোডিয়া আর ৪র্থ ও ৫ম স্থানে আছে সেনেগাল ও মোজাম্বিক।
গত বছরে এফডিআই কমে যাওয়ার বিষয়টির কারণ অবশ্যই খুঁজতে হবে। এখন থেকে বিষয়টির ওপর পর্যবেক্ষণ করা না হলে ভবিষ্যতে দেশের জন্য অর্থনীতির ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা বয়ে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও এবং তাদের বিশেষ অঞ্চলে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নিশ্চিয়তা পরেও বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করা হচ্ছে।
ফরেন ইনভেস্টমেন্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক এম নূরুল কবিরের অভিমত, বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাসের ক্ষেত্রটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সরকারের কিছু রেগুলেশনে বিনিয়োগে অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রথা চালু ছিল। প্রণোদনা প্রাপ্তিতে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়েছিল। কোনো কারণ ছাড়াই এক বছর পরই সেই প্রণোদনা তুলে নেওয়া হয়। তারপর বিনিয়োগকারীদের ওপর আবার এসডি ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে এদের ব্যবসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশিরা কিন্তু এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করেন না। তারা দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা নিয়ে দেশে বিনিয়োগ করতে আসে। অনেক সময় তারা বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ও বিনিয়োগের হালচাল নিয়ে ধারণা নিয়ে থাকে। সেখানে যদি দেখেন পলিসিতে অনিশ্চিয়তা আছে তাহলে তো তারা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন কি করে?
অবশ্য নীতিনির্ধারকরা মনে করে থাকেন সস্তা শ্রমের বড় একটি উৎস বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে বলে বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেই। তাদের জন্য বিশেষ অঞ্চল তৈরি করতে পারলে দেশে ভালো এফডিআই আসবে বলে তাদের ধারণা। বিশেষ অঞ্চলে বরাদ্দ দেওয়া হলো তারপরও বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার কারণ কি? সস্তা শ্রমের ধারণাটি কাজের ক্ষেত্রে কতটা যুক্তিসংগত? কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ টানতে সস্তা শ্রমই কি যথেষ্ট? আমাদের বুঝতে হবে সস্তা শ্রম দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার দিন এখন শেষ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পূর্ণ শ্রমিক প্রয়োজন- সেটা চাহিদার তুলনায় আমরা কি দিতে পারছি?
অন্যান্য দেশে জমির প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক জমি পেয়ে যায়। ভূমি আইন এর বিভিন্ন জটিলতার কারণে দেশে জমি প্রাপ্তিতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বিনিয়োগ কার্যাদি সম্পাদনে অনেক দেরি হয়।
টেকসই জ্বালানি সরবরাহ আরেকটি উদ্বেগের কারণ। শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের নিশ্চিয়তা নেই। এতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। কাঙ্ক্ষিত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমাদের দেশে ভ্যাট ট্যাক্স অন্যান্য নীতিমালাগুলো দ্রুত পরিবর্তন হয় এদের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিরক্তবোধ করে।
দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম আছেই। এটির কারণে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না। ঘুষের জন্য জনপ্রতিনিধিরাও হাত বাড়ায়। তাহলে সহযোগিতা কার থেকে নেবে? সুশাসনের বড্ড অভাব এর কারণে বিনিয়োগ সম্প্রসারণে অন্তরায় হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক করনীতি ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছে। তার কোনো গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। বরং প্রতিবছর করনীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে এদের সমন্বয়টা হচ্ছে না। তাছাড়া গত বছরটি বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের বছর ছিল। সরকারি ও বিরোধী দলগুলো পুরো বছরই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অতিবাহিত করেছে। রাজনৈতিক সহিংসতা উত্তেজনাও বেশ বেড়ে ছিল। এটার কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণও থাকতে পারে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। তাই বাংলাদেশ যদি আরও বেশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় তাহলে বন্দরের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তার উন্নয়ন করতে হবে তাহলেই এফডিআই দেশে আসবে। যেসব জায়গায় আমাদের দুর্বলতা আছে তা দ্রুত সমাধান করতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে যাব। তা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হতে পারে না।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা