রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। এটি একজন ঈমানদারের মর্যাদা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ, গোনাহ মাফের কারণ ও স্রষ্টার নৈকট্য লাভের উপায়। তিনি মানুষকে সুস্থতা দান করেন আবার তিনিই অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করেন যে, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে কে কৃতজ্ঞ আর কে অকৃতজ্ঞ? মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব। আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা যেকোনো ধরনের রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদে আল্লাহর ফয়সালা কায়মনোবাক্যে মেনে নেয় এবং নিজেদের সবকিছু আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে ঘোষণা করে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ আর আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে ঘোষণা করেছেন (বিপদাপদে ধৈর্যধারণকারী) এরাই ওই সব লোক, যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়। আর তারাই সুপথে পরিচালিত। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৭)
মুসলিম জাতির পিতা সাইয়েদেনা ইবরাহীম (আ.) অসুস্থ হলে মহান আল্লাহকে স্মরণ করতেন আর বলতেন যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে আহার্য ও পানীয় দান করেন এবং আমি অসুস্থ হলে তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন। (সুরা শুআরা, আয়াত: ৭৮-৮০)
কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, পাশে বসে সান্ত্বনা দেওয়া ও সেবা-শুশ্রূষা করা ঈমানি দায়িত্ব। তাছাড়া এটা রাসুলের বিশেষ সুন্নত ও বিপুল নেকি অর্জনের কাজ। কোনো মুসলিম যদি তার কোনো অসুস্থ ভাইকে দেখার জন্য পথ ধরে, যতক্ষণ সে পথ চলতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে জান্নাতের বাগিচার মধ্যে বিচরণ করতে থাকে। তারপর যখন সে উক্ত অসুস্থ ব্যক্তির পাশে বসে, তখন সে আল্লাহর রহমতের মধ্যে ডুবে যায়। যদি সে সকাল বেলা রোগীকে দেখতে যায় তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাজার ফিরিশতা কল্যাণের দোয়া করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যার সময় রোগীকে দেখতে যায়, তবে তার জন্য ভোর পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশতা দোয়া করতে থাকে। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান বরাদ্দ হয়। [তিরমিজি: ৯৬৯]
বহু হাদিসে রোগী দেখার অনেক ফজিলতের কথা এসেছে। এ-প্রসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাও, রোগীর শুশ্রূষা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করো। [সহিহ বুখারি : ৫৩৭৩]
মুয়াজ ইবনে জাবাল [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। আর যে ব্যক্তি ঘরে বসে থাকবে এবং কারো দোষ চর্চা করবে না, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। যে ব্যক্তি কোনো রোগী দেখতে যাবে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। যে ব্যক্তি কোনো ইমামের নিকট তার সম্মান প্রদর্শনের জন্য গমন করবে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। [মুসনাদে আহমাদ: ২২০৯৩]
আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমাদের মাঝে কে সিয়াম পালনকারী? আবু বকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আজ তোমাদের মাঝে কে একটা জানাজা পড়তে গিয়েছে? আবু বকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের মাঝে কে একজন মিসকিনকে আজ খাবার দিয়েছো? আবু বকর বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের মাঝে কে আজ একজন অসুস্থকে দেখতে গিয়েছে? আবু বকর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, আমি। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার মধ্যে এ কাজগুলোর সংমিশ্রণ ঘটেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিম: ১০২৮]
জাবের [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোগী দেখতে যায়, সে রহমতের ডুব দেয়। তারপর যখন তার পাশে বসে, তখন সে রহমতে স্থিরতা লাভ করে। [আদাবুল মুফরাদ: ৫২২]
আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে যায়, আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করে তুমি সুপ্রসন্ন হও। তোমার আগমন শুভ হোক। তুমি জান্নাতের ঘর প্রস্তুত করে নিয়েছ। [ইবনে মাজাহ: ১৪৪৩]
ইমাম তিরমিজি রাহিমাহুল্লাহু হাদিসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন- যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় কিংবা তার দীনি ভাইয়ের সাক্ষাতে যায়, একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, তুমি সুপ্রসন্ন হও। তোমার আগমন শুভ হোক। তুমি জান্নাতের ঘর প্রস্তুত করে নিয়েছ। [তিরমিযি: ১০০৬]
আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা মানব সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমায় দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা, আমি আপনাকে কিভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, তুমি তাকে দেখতে গেলে আমাকে তার কাছে পেতে। [সহিহ মুসলিম: ২৫৬৯]
আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি যুবক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমত করত। একবার সে অসুস্থ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে যান। তার মাথার কাছে বসে তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে তার পিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তার পিতা বলল, তুমি আবুল কাসিমের অনুকরণ কর। তারপর সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথা বলতে বলতে বের হলেন যে, সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি যুবককে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। [সহিহ বুখারি: ১৩৫৬]
আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, ৭০ হাজার ফেরেশতা বিকেল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। আর বিকেলে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়। [আবু দাউদ: ৩০৯৮, তিরমিজি: ৯৬৯, ইবনে মাজাহ:১৪৪২]
আবদুল্লাহ ইবনে আবি বকর তার পিতা থেকে তার দাদা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায়, সে রহমতে নিমজ্জিত থাকে। অতঃপর যখন সে রোগীর পাশে বসে, তখন সে রহমতের আরও গভীরে ডুব দেয়। তারপর যখন সে রোগীর নিকট থেকে ওঠে দাঁড়ায়, বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আবার রহমতে নিমজ্জিত থাকে। যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে বিপদাপদে সান্ত্বনা দেয়, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সম্মানের মুকুট পরিধান করাবেন। [বাইহাকি:৭৩৩৮]
সুওয়াইর ইবনে আবি ফাখেতা তার পিতা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহু] আমার হাত ধরে বললেন, আমার সঙ্গে চলো, হুসাইন অসুস্থ, তাকে দেখে আসি। আমরা গিয়ে তাঁর কাছে আবু মুসা [রাদিয়াল্লাহু আনহু])-কেও পেলাম, আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, আবু মুসা, রোগী দর্শনের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন না এমনি বেড়াতে এসেছেন? তিনি বললেন, না রোগী দেখার নিয়্যতে এসেছি। আলী [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, কোনো মুসলিম যদি কোনো মুসলিম রোগীকে দেখতে যায় তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য সত্তর হাজার ফিরিশতা দোয়া করেন। আর যদি সন্ধ্যার সময় কোনো মুসলিম ব্যক্তি রোগীকে দেখতে যায় তবে তার জন্য ভোর পর্যন্ত সত্তর হাজার ফিরিশতা দোয়া করেন। আর তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান বরাদ্দ হয়। [তিরমিজি: ৯৬৯]
সাওবান [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- একজন মুসলমান যখন অপর মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়, তখন সে জান্নাতের (খুরফায়) ফল আহরণ করতে থাকে। প্রশ্ন করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ! খুরফাতুল জান্নাত কি? তিনি বললেন, এটা জান্নাতের কুড়ানো ফল। [মুসলিম: ২৫৬৮]
যে ব্যক্তি তার দীনি ভাইকে দেখতে যায়, সে জান্নাতি।
আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোনো মুসলিম ব্যক্তি যদি তার দীনি ভাইকে দেখতে যায়, আকাশ থেকে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করে বলে, তুমি সুপ্রসন্ন হও এবং তোমার জান্নাত শুভ হোক। তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা আরশের ফেরেশতাদের মধ্যে ঘোষণা করেন- সে আমার জন্যই সাক্ষাৎ করতে এসেছে, তার আতিথেয়তার দায়িত্ব আমার। সুতরাং জান্নাত ব্যতীত অন্য কোনো আতিথেয়তায় আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হব না।
ইমাম তিরমিজি [রাহিমাহুল্লাহু] একটি হাদিস এভাবে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় কিংবা তার দীনি ভাইয়ের সাক্ষাতে যায়, একজন ঘোষক ঘোষণা করেনÑ তুমি সুপ্রসন্ন হও। তোমার আগমন শুভ হোক। তুমি জান্নাতের ঘর প্রস্তুত করে নিয়েছ। [ তিরমিজি: ১০০৬]
আনাস [রাদিয়াল্লাহু আনহু] থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-Ñআমি তোমাদেরকে তোমাদের জান্নাতি পুরুষদের ব্যাপারে অবগত করব না? সাহাবিগণ বললেন, হ্যাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ! বলুন। তিনি বললেন, নবীগণ জান্নাতি, সিদ্দীকগণ জান্নাতি, শহীদগণ জান্নাতি, নবজাতক শিশুরা জান্নাতি এবং যে ব্যক্তি তার দীনি ভাইকে শহরের দূরপ্রান্তে দেখতে যায়; একমাত্র আল্লাহর জন্যই দেখতে যায়, সেও জান্নাতি।
আমি কি তোমাদের জান্নাতি স্ত্রীদের সম্পর্কে কি তোমাদের অবগত করব না? যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, বারবার ভুল করে বারবার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী (যার স্বামী রাগ করলে অথবা), যে অত্যাচারিতা হলে, সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি রাজি (শান্ত) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাব না। [ আলমুজামুল কাবির; তাবরানি: ১৫৬৩৭]
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা