আপডেট : ৬ নভেম্বর, ২০২২ ১১:৩৭
শীত উপলক্ষে জমজমাট আক্কেলপুরের তাঁতপল্লি
রাব্বিউল হাসান, জয়পুরহাট

শীত উপলক্ষে জমজমাট আক্কেলপুরের তাঁতপল্লি

তাঁতের মেশিনে চাদর তৈরিতে ব্যস্ত এক কারিগর। গতকাল শনিবার সকালে জয়পুরহাটের শ্যামপুর গ্রামে। ছবি: দৈনিক বাংলা। 

দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। এরই মধ্যে বইতে শুরু করছে উত্তরের হাওয়া। শীতকে সামনে রেখে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের তাঁতপল্লিতে শুরু হয়েছে ব্যস্ততা। তাঁতিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চাদর ও কম্বল তৈরির কাজে।

তিলকপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর, স্বরসতীপুর ও মোহনপুরের তিনটি গ্রামের প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবারের জীবিকার প্রধান উৎস তাঁতশিল্প। আধুনিক শিল্প বিপ্লবের যুগেও এই তিনটি গ্রামের তাঁতিরা বস্ত্র তৈরি করে টিকিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের পেশা।

সরেজমিনে এই তিনটি গ্রামে দেখা গেছে, খটখট শব্দে মুখরিত তাঁতপল্লি। কেউ বাড়িতে বসে সুতা নাটাই করছেন, কেউ আবার সুতা টানা করছেন। কেউ আঁচবউ করছেন, কেউ বিদ্যুৎচালিত মেশিনে কিংবা হস্তচালিত মেশিনে গামছা, তোয়ালে, চাদর, কম্বল বুনছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই তাঁতপল্লিতে অল্পসংখ্যক বিদ্যুৎচালিত তাঁত ছাড়া বাকি সবই হস্তচালিত। একসময় শুধু মশারি তৈরি করা হলেও এখন এই তাঁতপল্লিতে তৈরি হচ্ছে গামছা, তোয়ালে, চাদর, কম্বল। সারা বছর এখানে তাঁতের কাজ করেন কারিগররা।

শীত মৌসুমে তাঁতিদের ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এসব তাঁতে সারা বছর ধরে গামছা তৈরি করা হলে শীতকে সামনে রেখে তাঁতিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন চাদর, কম্বল তৈরির কাজে। এই এলাকার উৎপাদিত গামছা, চাদর, কম্বল ভালোমানের হওয়ায় নিজ এলাকা ছাড়াও রাজশাহী, যশোর, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে বিক্রি করা হয়ে থাকে।

শ্যামপুর গ্রামের তাঁতি আসলাম হোসেন (৫০) বলেন, নারীদের ব্যবহারের দুই হাত প্রস্থ ও পাঁচ হাত দৈর্ঘ্যের একেকটি চাদর তৈরিতে ৪০০ গ্রাম রুল সুতার প্রয়োজন হয়। পুরুষদের তিন হাত প্রস্থ ও ছয় হাত দৈর্ঘ্যের একেকটি চাদর তৈরি করতে উলের সুতার প্রয়োজন হয় ৫০০ গ্রাম। এক দিনে ১৪-১৬টি চাদর তৈরি করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে এক দিনে বড় আকারের সুতি সুতা দিয়ে ১২-১৬টি গামছা তৈরি করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি কম্বল তৈরি করতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১ কেজি মখমলের সুতা।

মোহনপুর গ্রামের তাঁতি আশরাফুল ইসলাম (৩৫) বলেন, তাঁতের কাজ করে প্রতি মাসে ১৪-১৬ হাজার টাকা আয় হয়ে থাকে। নারীদের ব্যবহারের প্রতিটি চাদর ১৪০-২৪০ ও পুরুষদের ব্যবহারের চাদর ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। কম্বল ২১০-২২০ টাকায় এবং প্রতিটি গামছা ৫০-৫৫ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হয়। পাশের জেলা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সাঁওইল ও সান্তাহার বাজারে এসব চাদর ও কম্বল বিক্রি করেন তাঁতিরা।

তবে বর্তমানে ঠিকমতো সুতা না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম, যা তাদের বাড়তি আয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কোনো সুতার বাজার না থাকায় পাশের জেলা বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সাঁওইল বাজার থেকে এই অঞ্চলের তাঁতিরা সুতা সংগ্রহ করেন।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্রিটিশ আমলে ট্রেনে ভারত থেকে সুতা নিয়ে এসে এই এলাকার তাঁতিরা কাজ করতেন। প্রায় ৩০-৪০ বছর আগেও স্থানীয় বাজারে সুতা পাওয়া যেত।

আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম মাহবুব বলেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেক পরিবার এই পেশা পরিবর্তন করেছে। তবে যেসব পরিবার তাঁতশিল্পের ওপর নির্ভরশীল তাদের স্বল্পসুদে ঋণসহ সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে তাঁতিরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।