
ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি তাকে ভীষণ টানে। প্রতিটা ঋতুর আলাদা ঘ্রাণ, রং তিনি ঠিক বুঝতেন। অবাক হয়ে দেখতেন প্রকৃতির খেলা। কি ভীষণ সুন্দর ঠেকতো তার কাছে সে বয়সেও। এমন সুন্দরের বর্ণনা কীভাবে করবেন তিনি, তা বোঝার বয়সও তখন হয়নি। ঠিক সে বয়সেই রং, তুলি আর ক্যানভাস হাতে নিলেন প্রকৃতির সৌন্দর্য নিজের মতো করে প্রকাশের জন্য। সেই থেকে শুরু, এখনও নিজের মনের ভাব, প্রকৃতির কথা কিংবা জীবনবোধের গল্পটা বলার জন্য ক্যানভাসটাকেই বেছে নেন শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন। ‘দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন-২’ শিরোনামে ঢাকার বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে বরেণ্য এ শিল্পীর একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনী শুরুর আগের সন্ধ্যায় প্রবীণ এ শিল্পীর সঙ্গে আলাপে ওঠে এসেছে তার শিল্প ও ব্যক্তিজীবনের গল্প। তারই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য-
বেঙ্গল শিল্পালয়ের গ্যালারির দরজা ধাক্কা দিতেই ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলেন সফেদ সাদা চুল, চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা পরা এক প্রৌঢ়। তিনি শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন। তখন আগামী কালের পুরো আয়োজনের জন্য প্রস্তুত গ্যালারি। দেয়ালগুলোতে ঝোলানো হয়েছে খ্যাতিমান এ শিল্পীর শিল্পকর্ম। বসতে বসতেই তিনি বলা শুরু করলেন- আমি তো লিখতে পারি না, গুছিয়ে বলতেও পারি না। কেবল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারি আমার ভাবনাগুলো। তাই তোমাকে এখানেই ডেকে এনেছি (চারপাশ দেখিয়ে) পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য। আমার এ শিল্পগুলোই হয়তো কথা বলবে।
কোনোটা তেলরঙে আঁকা, তো কোনোটা জলরঙে। একেকটা চিত্রকর্ম যেন একেকটা গল্প বলছে। এক পাশের দেয়ালে ঝোলানো কয়েকটি ছবি দেখিয়ে তিনি বললেন, এ ধারণাটি আমি পেয়েছি জাপানি নিহঙ্গা রীতি থেকে। তবে বাংলাদেশের নকশিকাঁথা থেকেও নাকি নিয়েছেন ধারণা। সে সঙ্গে তিনি আরো বলেন- আমি সব সময় প্রকৃতিকেন্দ্রিক কাজ করতে ভালোবাসি। মূলত প্রকৃতিই আমার বিষয়, প্রকৃতিই আমার অনুপ্রেরণা। আর জলরঙে আমি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাই।
প্রকৃতিই আমার অনুপ্রেরণা আর জলরঙে আমি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাই
১৯৭০ সালে সরকারি আর্ট কলেজ (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পাস করেন। সেখানে পড়াকালীন প্রায় ৫ হাজার ছবি একেঁছেন যার সবই নাকি ছিল প্রকৃতিকে ঘিরে। তিনি বলেন, খুব যদি ভুল না করি তাহলে বলতে পারি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল- দীর্ঘ এ সময়টা আমি জলরঙে প্রকৃতি বা বাস্তবধর্মী ছবিই এঁকেছি। এরপর মনে হলো আমাকে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তখন ধীরে ধীরে আমি ধরন বদলাতে থাকি, নানা রকম পরীক্ষা করতে থাকি। তবে এত কিছুর পরও প্রকৃতিই কিন্তু রয়ে গেছে আমার ছবি আঁকার পেছনের ঢাল হিসেবে। বলা যায়, প্রকৃতিই আমাকে ছবি আঁকায়।
জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন। টোকিওর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে শিল্পকলায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা প্রথম বাংলাদেশি তিনি। সেখানে শিক্ষকতাও করেছেন কিছু সময়। কিন্তু শিক্ষকতায় সময় দেয়ার চেয়ে নিজের শিল্পকর্ম গড়তেই যেন মনোযোগ ছিল তার বেশি। বর্তমানে বছরের অধিকাংশ সময়ই থাকেন জাপানে। সেখানে কিভাবে সময় কাটান কিংবা কোন সময়টাকে বেছে নেন কাজের জন্য, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে আসলে সাহায্যকারী লোক নেই। তাই দিনের বেলায় আমি গৃহস্থালি কাজগুলো সারি। রাতের সময়টা আমার জন্য রাখি। তখন মূলত শিল্পচর্চায় সময় দেই।
খানিকটা একাকী, নিভৃতে থাকতেই ভালোবাসেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, আমি কারো সঙ্গে সেভাবে মিশি না। আসলে মিশতে পারি না। একা একা নিজের কাজ নিয়েই পড়ে থাকি। এভাবেই দিন চলে যায় কিভাবে যেন। হয়তোবা নিরিবিলিতে কাজের জন্যই ৩০ বছর আগে সাভারে একটা কাজের জায়গা তৈরি করেছিলেন। বিশাল জায়গায় ছোট্ট দোতলা বাড়ি। এর ওপরের তলায় স্টুডিও। আর নিচ তলায় থাকার জায়গা। এখন বিশেষ কোনো কাজ কিংবা এমন কোনো প্রদর্শনী হলে বাংলাদেশে এলে সেখানেই থাকেন। রাজধানীর কোলাহল যাতে তাকে ছুঁতে না পারে এটাই চাওয়া যেন তার। দেশে থাকলে সারা দিনই তার কেটে যায় স্টুডিওতে।
এবার টোকিও থেকে শিল্পীর সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছেন তার একমাত্র কন্যা কাজী মায়া। কথা প্রসঙ্গে কন্যার কথাও বলেছেন। জাপানে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন মডেল এবং লেখিকা তার মেয়ে। বাবার কাজে সাহায্য করেন কখনো কখনো। এবারও নাকি বাবার প্রদর্শনীর ক্যাটালগে রয়েছে মেয়ের একটা লেখাও। মেয়ের সঙ্গে শিল্পীর এক প্রজন্ম ফারাক। দুজনের সম্পর্কেও রয়েছে বৈপরীত্য। তবে বাবার শিল্পের গুণমুগ্ধ ভক্ত মায়া। অন্যদিকে বাবাও তার একমাত্র কন্যার লেখালেখির ভক্ত।
‘দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন টু’
করোনা মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে ‘দ্য ওয়ার্ক অব ক্রিয়েশন’-এর প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল। দুই বছর বাদে এ বছর অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবারে আয়োজন করা হয় এক মাসব্যাপী দ্বিতীয় দফার প্রদর্শনী। এবারের আয়োজনে শিল্পকর্মগুলো কাগজে জলরং, তেলরং, বোর্ডে তেলরং ও কোলাজ মাধ্যমে তৈরি। এর মধ্যে জলরঙের শিল্পকর্মগুলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী নিহঙ্গা রীতি থেকে এবং তেলরং চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নকশিকাঁথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেছেন বলেই জানান শিল্পী কাজী গিয়াসউদ্দিন। অন্যদিকে কোলাজ শিল্পগুলো তৈরির ক্ষেত্রে কাগজ ছিঁড়ে ও জোড়া দিয়ে চমৎকার কম্পোজিশনে তৈরি করা হয়েছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা