আপডেট : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৬:৫০
বিপ্লবোত্তর সামাজিক শান্তি ও বাঙালির অস্থির চিত্ত
ড. মো. ইকবাল হোছাইন

বিপ্লবোত্তর সামাজিক শান্তি ও বাঙালির অস্থির চিত্ত

ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে এতটাই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, এ দেশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলাফেরা বা নিশ্বাসও নেওয়া যাবে, এ চিন্তাই করা যেত না। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ডাকে ছাত্র-জনতার এ বিপ্লবে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ হলেও তা অনেকটা স্বপ্নের মতো। আবার ফ্যাসিবাদীরা ৪ আগস্ট রাতেও যে হুংকার দিয়েছে এবং ৫ আগস্ট সকালেও যেভাবে দাম্ভিকের মতো মানুষ হত্যা করেছে এবং এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজ্য পতনের মধ্যে রেখে শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তাও তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। রিমান্ডে সালমান এফ রহমানের স্বীকারোক্তিতে একথা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। দীর্ঘ ১৭ বছরের অত্যাচার, অপমান, হত্যা, দুর্নীতি ও ব্যাংক লুটের কারণে একেবারেই ভেঙে পড়া প্রশাসনের ভার বিশ্বের অন্যতম সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ উপদেষ্টাদের হাতে যাওয়ায় মানুষে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার জায়গাটি অনেক বেশি। যদিও আমরা জানি প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে দীর্ঘ ১৭ বছরের একটি জেনারেশন গ্যাপ হয়েছে। সব সেক্টরে এ বিষবাষ্প ছড়ালেও পুলিশে এর সংক্রমন ছিল আত্মঘাতী। কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রমবাদে কেবল হাসিনাবন্ধনে এবং আওয়ামী লীগের খায়েস পুরণে ব্যতিব্যস্ত ছিল। এ পুলিশ বাহিনীর নৈতিকতাহীনতার মাত্রা এত ব্যাপক ছিল বিপ্লবের দিন ছাত্র-জনতার রাগ ও ক্রোধ এদের ওপরও ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। বিপ্লব পরবর্তীতে গত প্রশাসনের নিয়োগকৃত এসব পুলিশ মাসসিকভাবে এতটা ট্রমা ও ভয়ে আছে যে, তারা নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে পূর্ণ শক্তি নিয়ে এখনো জনগণের পক্ষে সেবা দেওয়ার জন্য সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য অথচ এ পুলিশ বাহিনীর সক্রিয় হওয়া অতি জরুরি। সরকার গঠনের পর তিন সপ্তাহ হয়ে গেল এখনো ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ সেভাবে কাজ করছে না। পুলিশকে এ ট্রমা থেকে বের করার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জরুরি ভিত্তিতে কি কাজ করছেন আমাদের জানা নেই। তবে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরের জানজট, বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় জনমনে নিরাপত্তা নিয়ে শংকা দেখা দিচ্ছে। আমার মনে হয়, বিপ্লব পরবর্তী এ অবস্থা মানুষের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারে! ফ্যাসিবাদী প্রশাসনের নিয়োগকৃত পুলিম হলেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে আরও কার্যকরভাবে তাদের কার্যকর করতে হবে। তিনি ৮ [আট] ঘণ্টা অফিস করলে চলবে না। প্রয়োজনে দিনরাত কাজ করে রাজারবাগসহ বিভিন্ন চৌকি, ফাড়ি তাৎক্ষনিক ভিজিট করতে হবে এবং অত্যন্ত সাবলীলভাবে মিডিয়া কভারেজে আসতে হবে। মনে রাখবেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দাপটি কথাবার্তা ও আচার আচরনের ব্যাপক প্রভাব বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীসহ জনগণকে প্রভাবিত করে। আইন উপদেষ্টা অত্যন্ত চৌকুষ ও মেধাবী মানুষ। বলা হয় সাধারণ মানুষ ও চাকরীজীবিদের একচক্ষু যা কেবল সামনেই দেখে কিন্তু একজন গবেষকের চক্ষু অগণিত এবং চতুর্দিকের তার নজর। আমি মনে করি আসিফ নজরুলের ক্ষেত্রে কথাটি দারুনভাবে প্রযোজ্য। তিনি তার বিভিন্ন বক্তৃতায় কোর্ট প্রাঙ্গণে আসামিদের ওপর আক্রমণের কারণ ও এর প্রতিকার চেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি এসব কাণ্ডের নিন্দাও করেছেন। খুবই আশার কথা। আমরা উপদেষ্টার এমন আচরন প্রত্যাশা করি। তবে তাকে অবশ্যই কোর্টের সীমার মধ্যে এসব হামলা বন্ধে আরও কার্যকরী হতে হবে। এরূপ গণবিপ্লবের সময় আরও বেশি অত্যাচার বা রক্তক্ষরণ হয়, বিশেষ করে যারা অত্যাচারিত তাদের ক্ষোভকে আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা যায় না। তারপরেও উপদেষ্টাকে মনে রাখতে হবে, উন্মুক্ত তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ছোটখাটো এ ঘটনা বিপ্লবের অর্জনকে ব্যাহত করছে, কোনো কোনো ঘটনা মানুষকে অস্থির করে তুলছে। বিপ্লবের সাফল্যেও পর পরাজিতদের ওপর বিজয়ীরা অনেক অপরাধ করে এর নজির বিশ্বে অনেক আছে তাবে তা যে দীর্ঘ মেয়াদী সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাকে ডেকে আনে তা যতদ্রুত ক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতা ও ভোক্তভোগীরা বুঝতে ততই মঙ্গল হবে। বিপ্লব সংহত না করে কেবল জিঘাংসার চাষ করলে কি পরিণতি হয় কম্ভোডিয়ার বিপ্লবী নেতা পলপটের জীবনী, কর্মকাণ্ড, সরকার গঠন ও দ্রুতার সঙ্গে শোচনীয় পতন থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। চাওয়া-পাওয়া বাস্তবতা ও অস্থিরতার মধ্যে সমন্বয়ের জন্যে সরকারকে আরও দ্রুত ও দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একথা মনে রাখতে হবে, এ বিপুল জনসমর্থন তাদের দ্রুত কর্মতৎপরতার ওপর নির্ভর করবে।

আমি একজন শিক্ষক। বিপ্লবের সিংহভাগ কাজের নেতৃত্বে ছিল আমাদের ছাত্র সমাজ। সুতরাং শিক্ষক হিসেবে সংবিধিবদ্ধভাবেই আমার অনেক কর্মকান্ড শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযুক্ত। দীর্ঘদিন আন্দোলন, ফ্যাসিবাদের পতনের পর শিক্ষার্থীরা দ্রুত ক্লাসে ফিরতে চায়। বিশেষ করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে আছে কখন তারা ক্লাসরুমে ফিরবে। কিন্তু অনেকটাই তাদের বিধিবাম। আমাদের মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা একজন বিচক্ষণ প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ এ ব্যাপারে কারও কোনো বিতর্ক নেই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগ দিতে চান তাতেও কারো দ্বিমতো নেই। তবে প্রশ্ন হল, তাহলে কেন মাননীয় উপদেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভিসি, প্রো-ভিসি নিয়োগ দিতে এত দেরি করছেন?। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মেধাবী ভিসি নিয়োগ দিয়ে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সবাই আশা করে, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধাবী ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ দেওয়া দিবেন। গত তিন সপ্তাহে ভিসি না দেওয়ার কারণে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার ছাড়াও প্রক্টরিয়াল বডি কাজ করছে না। সব প্রভোস্ট ও আরও বিভিন্ন দায়িত্বের জায়গাগুলো এখন একেবারে শূন্য। নিরাপত্তার প্রশ্ন আসলে এখন কে নির্দেশনা দিবে বা পরিস্থিতি সামলাবে। শিক্ষার্থীরা এখন বিভাগীয় চেয়ারম্যান, শিক্ষাকবৃন্দসহ সকলের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিচ্ছেন, কিন্তু একাডেমিক কার্যক্রম নতুন ভিসি না আসলে চালানো যাবে না এরূপ প্রজ্ঞাপনের কারণে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা শিক্ষকরা অংশ নিতে পারছেন না। বিষয়টি উপদেষ্টা দ্রুত নজরে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সচল করার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে আমার মনে হয় অস্থিরতা অনেকটাই কেটে যাবে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী সফল এ বিপ্লবে শিক্ষার্থীরা সামনে থেকেছে সবকে এবং এ আন্দোলনে সবকে বিশ্বস্থতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক দল ও মতের লোকজন সম্পৃক্ত হয়েছেন কিন্তু সফল হতে পারেননি। জনগণনকে সর্বাত্মকভাবে তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করা যায়নি। আমি আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচালিত আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে এবং প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ যে পচন ধরেছে তা থেকে মুক্ত করার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে , অস্থিরতা সৃষ্টির পরিবর্তে তাদের সহযোগিতা করলে, তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে আমার মনে হয় রাজনৈতিক দল বা নাগরিক হিসেবে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করা হবে। এ সফল বিপ্লবকে ধরে রাখার জন্য মানুষের আপ্রাণ প্রচেষ্টার অনেক প্রমাণ ইতোমধ্যেই ছাত্র-জনতা দিয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা কয়েকটি ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত নস্যাৎ করেছে। শিক্ষার্থীরাতো সর্বদা সরকার পাহারা দেওয়ার জন্যে বসে থাকবে না। এ দায়িত্ব আপামর জনসাধারণকে নিতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন আরও চৌকুষ ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করতে হবে তেমনি বিপ্লব-পরবর্তী এ অবস্থার সুফল সাধারণ মানুষের মনন ও কর্মে স্থায়ী করার জন্য ধৈর্যের সঙ্গে সরকারকে সময় দিতে হবে। অস্থির চিন্তা ও চেতনার বসে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ভ্যানগার্ড হিসেবে জাগ্রৎ থেকে বিপ্লবকে সফলতার মনজিলে মকসুদে পৌঁছে দিতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়