আপডেট : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৬:৪২
বন্যার্তদের পুনর্বাসনই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
শাখাওয়াত হোসেন

বন্যার্তদের পুনর্বাসনই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

দেশের এক-চতুর্থাংশ বন্যাকবলিত। বন্যার্তদের হাহাকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলেছে বন্যার করাল গ্রাস। পানি নেই, খাবার নেই, আশ্রয়ের জায়গা নেই। বন্যার ভয়াবহতা সত্যি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি এবার সচক্ষে বন্যা দেখেছি। আমি গত ২১ আগস্ট বুধবার তিন দিনের ছুটি নিয়ে ফেনীর সোনাগাজীর উদ্দেশে রওনা দিই। ঢাকা থেকেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলতে শুরু করেছি। ভাবছি এরকম বৃষ্টি তো হয়ই। আর এখন তো বৃষ্টির সময়ই। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। এখানে বৃষ্টিও এক ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমাদের দেশের মানুষ বৃষ্টি উপভোগ করে; কিন্তু এই বৃষ্টিই এক সময় মানুষের দুর্ভোগ ডেকে আনে। ফেনীতে পৌঁছার আগেই বৃষ্টি বাড়তে থাকে। ফেনী পৌঁছে দেখি এক হাঁটু পানি, অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ফেনীতে একটু কাজ ছিল। বৃষ্টিতে শহরের অধিকাংশ এলাকা ডুবে গেছে। আধাঘণ্টার মধ্যে দেখলাম আমিও প্রায় ডুবে যাচ্ছি। তড়িঘড়ি করে আমার উপজেলা সোনাগাজীতে কোনোরকমে পৌঁছার ব্যবস্থা করলাম। ভাবলাম আমাদের এলাকা নিরাপদ; কিন্তু না, শুক্রবার থেকে সোনাগাজীর উত্তরাঞ্চল ডুবতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে পানি উপজেলা সদরের দিকে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম উপজেলা সদরে পানি উঠে গেছে। মানুষ স্কুল-মাদ্রাসাসহ যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে। দেখলাম মানুষের কান্না। উদ্ধার ও সাহায্য করার জন্য অনেকে এগিয়ে এসেছেন; কিন্তু তাৎক্ষণিক এই দুর্যোগে সবাই হতবাক। যারা উদ্ধার করতে গেছেন, তারাও বন্যার পানির স্রোতে নাকাল। অনেকে ত্রাণের ট্রাক নিয়ে গেছেন; কিন্তু এই ট্রাক বন্যাকবলিত এলাকা থেকে অনেক দূরে রাখতে হয়েছে। হাইওয়ে সড়ক ডুবে গেছে। এরপর হেঁটে-বা কতটুকু যাওয়া সম্ভব। যারা বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ নিয়ে গেছেন তারা প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছতে পারেননি। অনেকে তাই আশ্রয়ের পাশাপাশি খাবারে প্রচণ্ড কষ্টে দিন যাপন করেছেন। কেউ বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা রেখে এসেছেন। তাদের জন্য চিন্তা করছেন। আবার এক মহিলাকে দেখলাম অঝোরে কাঁদছেন। তার ৫ বছরের ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে প্রথম দিকে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট থাকলেও পরে এলাকা এবং এলাকার বাইরে থেকে প্রচুর ত্রাণ আসায় খাবারের আর পানির সংকট হয়নি; কিন্তু তাদের ওই এক চিন্তা সবকিছুই তো শেষ। এখন তারা নিঃস্ব। এক দিন আগে যিনি অন্যকে খাবার দিতেন, আজ তিনি নিজেই অন্যের কাছ থেকে খাবার নিচ্ছেন। এসব দৃশ্য দেখে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবে মানুষ মানুষের জন্য- এ কথাটির প্রমাণ পেলাম এবার। সবাই কোমর বেঁধে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মানুষের পাশে থেকে সর্বাত্মক সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। বন্যায় দেশের ১১ জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯ পরিবার। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৫২ লাখ মানুষ।

১১টি জেলার ৭৩ উপজেলার ৫৪৫ ইউনিয়ন-পৌরসভা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৬৭ জন। সরকারি হিসাবে পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন এবং ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য ৭৪৮টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।

ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও কক্সবাজারের কোথাও কোথাও অনেক মানুষ আটকে ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ। বন্যায় প্লাবিত অঞ্চলগুলোর পরিবহন ব্যবস্থায়ও মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে লাইফলাইন বলা হয়। কিন্তু এই মহসড়কও প্রায় ৫/৬ দিন বন্ধ ছিল। এরপর চালু হলেও খুবই ধীরগতিতে যানবাহন চলেছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রেরও অভাব দেখা দিয়েছে। ফেনীতে পাইকারি বাজার পুরোটাই ডুবে যায়। ফলে এ জেলার বন্যাকবলিত প্রায় সব উপজেলায়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় সংকটের পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই যেন এক মোক্ষম সময়। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যখনই কোনো দুর্যোগে মানুষ সর্বস্বান্ত হয় তখনই দেখা যায় অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মানুষের চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এবার বন্যায় দেখা গেছে হঠাৎই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। ১০ টাকার মোমবাতি ৫০ টাকা, মোমবাতি না পেয়ে মানুষ যখন কুপিবাতি খুঁজছিল তখন দেখা গেল ২০ টাকার কুপিবাতি ৭০-৮০ টাকা। তাও পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে সংকট দেখা দিয়েছিল সিলিন্ডার গ্যাসের। মুহূর্তের মধ্যে ব্যবসায়ীরা হাওয়া করে ফেলেছে সিলিন্ডার গ্যাসের বোতল। নাই তো নাই-ই। মাঝেমধ্যে দু-একটি দোকানে পাওয়া গেলেও দাম ছিল আকাশচু্ম্বী। দেখা গেছে, একটি সিলিন্ডার বোতল স্বাভাবিক সময়ে ১৫-১৬শ টাকা হলেও তা মুহূর্তে ডাবল হয়ে গেল। অনেককে জিজ্ঞেস করেও হঠাৎ দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ সময় যেখানে প্রতিটি মানুষের মানবিক হওয়ার কথা, সেখানে অনেকেই খুবই ক্ষুদ্র স্বার্থে চরম অমানবিক হয়ে মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলে দেন। অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও আমরা দেখেছি। সাম্প্রতিক সময়ে যে তরুণ সমাজ একটি দেশকে রাহুমুক্ত করেছে, সেই তারাই ত্রাণসহ মানবিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমরা দেখলাম রাজধানীতে যখন ট্রাফিকের ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তখন ছাত্ররা রাতদিন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও আমাদের ছেলেমেয়েরা সবার আগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। তারা বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। রাত-দিন তাদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করে। তাদের এই পরিশ্রমের কারণে অনেক ক্ষেত্রে বন্যার্তদের দুর্ভোগ কমেছে বলে অনেকে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।

আশার কথা ইতোমধ্যে বন্যা উপদ্রুত এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে পানি নেমে গেছে; কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, হাঁস-মুরগি সবই শেষ। শূন্য ভিটায় শুধুই ক্ষতচিহ্ন। এই ক্ষতচিহ্ন কীভাবে শুকাবে এই চিন্তায় দিন কাটছে বন্যার্তদের। বন্যাদুর্গত এলাকায় নিস্ব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আগে একটি ব্যাপক পরিসংখ্যান জরুরি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে তাদের কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা নির্ধারণ করতে হবে। তারপর পরিকল্পিতভাবে তাদের কাছে শুধু সাহায্য পৌঁছানো নয়, এই সাহায্য যাতে তাদের কাজে লাগে সে জন্য একটি কমিটি করে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

প্রকৃতি মাঝেমধ্যে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়। এ জন্য আমরাই দায়ী। দেশে নদী-নালা-খাল-বিল সবই ভরাট এবং দখল হয়ে গেছে। প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার পরও সেই পানি যে সাগর বা নদীতে যাবে তার কোনো সুযোগ আমরা রাখিনি। সবকিছু যেমন ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি অনেকে দখল করে সেখানে হাইরাইজ বিল্ডিংও ওঠাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সরকারি খাল উদ্ধারে তোড়জোড় দেখি। এরপরই সব আগের মতো। মাঝখানে যারা লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন তাদের পকেট ভারী হয়। আমরা যুগ যুগ ধরে ওই কালচারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ থেকে বের হতে না পারলে প্রতি বছরই প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে।

এখন দরকার সর্বাত্মকভাবে বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর। দুর্গত এলাকায় রোপা আমনের চারার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় শাকসবজি বলতে কিছু নেই। পুকুর উপচে সব মাছ বেরিয়ে গেছে। যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ করেছেন, তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। অনেক টিউবওয়েল ডুবে গেছে। কারও কারও পানি ওঠানোর মোটরও নষ্ট হয়ে গেছে। এসব টিউবওয়েল দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে না পারলে পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হবে। এ সময় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সবার নজর দিতে হবে। ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও ইদানীং বেড়েছে। তাই এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া বন্যার্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একটা সমন্বয় থাকতে হবে। সমন্বয় না থাকলে দেখা যায় কেউ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পায়, আবার কেউ মোটেই পায় না। তাই একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে যাতে সবাই সমানভাবে ত্রাণ এবং বাড়িঘর মেরামতের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

আমরা আশা করি সবার সহযোগিতা পেলে বন্যার্তরা খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে। যেকোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে আমরা একে অপরের সাহায্যে সবসময় এগিয়ে যাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই বড় ধরনের একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয়েছে। ইতোমধ্যে অত্যন্ত সফলভাবে সামাল দিতে পেরেছে। বাকি সমস্যাও দ্রুত সমাধান করতে পারবে বলে আমরা আশা করি। সরকারের পাশাপাশি জনগণও বন্যা মোকাবিলায় ব্যাপক অংশগ্রহণ করেছে। তাই আমরা আশা করি বন্যার সাময়িক অসুবিধা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পারব।

লেখক : সাংবাদিক