আপডেট : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১৬:৫২
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক
ড.আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক

দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নগ্ন দলীয়করণ, অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে শিক্ষাকার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। এই সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে এদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। তাই একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে এদেরকে চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয় খোলা-বন্ধের কোনো এখতিয়ার নেই। গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার পর শেখ হাসিনার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য ইউজিসি প্রজ্ঞাপন দেয়। গত ৫২ বছরে ইউজিসি এ কাজ করে নাই। এ ঘটনার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ ফ্যাসিবাদীদের দোসরদের নির্দেশে হয়েছে। যে করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এটা যদি ফ্যাসিবাদের নির্দেশে হয়ে থাকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এটা স্বৈরশাসকের নির্দেশে করে থাকলে সেটা জাতিকে জানাতে হবে এবং যিনি বা যারা নিয়মবহির্ভূতভাবে এ কাজটি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

শাস্তি লঘু বা গুরু হোক দিতে হবে। ইউজিসিতে যেসব অনিয়ম হয়েছে এগুলোর তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তদন্ত বা সরকার উচ্চপদস্থ তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে।

ইউজিসির বড় কাজ বাজেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বরাদ্দ দেওয়া। কিন্তু তাদের প্রধান কাজ কারিকুলাম দেখা। এটা যুগোপযোগী, কার্যকরী, গণমুখী কি না। যে জ্ঞান কাজে আসে না সে জ্ঞান দিয়ে আমি কী করব? গবেষণার জন্য টাকা দেওয়া আরেকটা কাজ। এই প্রতিষ্ঠানের দেখতে হবে এ গবেষণার মূল্যায়ন কী? এটা সমাজের কী কাজে লাগল? ইউজিসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন যেন আর না দেয়। ডিগ্রি বেচাকেনা করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বন্ধ করতে হবে।

এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ১৬ বছরে নোংরা দলীয়করণ করে লেখাপড়া একরকম শেষ করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞানচর্চা। এটা আর হয় না। এখন হয় দলচর্চা। বিগত ১৬ বছরে যারা হাসিনার শাসক দলে ছিল তাদের উন্নতি হয়েছে। তারা লেখাপড়া না করে ডিগ্রি পেয়েছে। শিক্ষকদের নিয়োগ-পদোন্নতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় নেই। এখন কঠোরভাবে যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে ধরতে হবে। আর ছাত্ররা যেন হলে সহাবস্থান করতে পারে। যারা অপরাধী তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, জেলে পুরতে হবে। এই পরিবেশ ফেরাতে হলে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি। ছাত্রদের প্রতি অনুরোধ তোমরা এখন ক্লাসে ফিরে যাও। তোমরা একটা মহৎ অর্জন করেছো। তোমরা দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন করেছো। তোমাদের জ্ঞানচর্চা করতে হবে। তোমাদের এই অর্জন যেন বৃথা না হয়। আবার যদি প্রয়োজন হয় আবারও আন্দোলন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও ক্লাস কিন্তু বন্ধ হয় নাই। যেখানে বোমা পড়েছে সেখান থেকে স্কুল-কলেজ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। একটা-দুইটা করলে তো হবে না। হয়তো অনেকে বলবে শিক্ষা কমিশন করে শিক্ষানীতি করতে হবে। এটা একটা দুরূহ কাজ। এটা না করে সরকার যেটা করতে পারে যে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো আছে এগুলো পর্যালোচনা করে কয়েকটা সুপারিশ করতে পারে। যেগুলোর কয়েকটি এক্ষুণি ইমপ্লিমেন্ট করতে পারে। একটা সুপারিশ আছে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা। এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। কারিগরি ও গণমুখী যে সুপারিশ আছে এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। এগুলো করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

পাবলিক সার্ভিস কমিশনতো (পিএসসি) দুর্নীতির কারখানা। প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। এটা বিলুপ্ত করে নতুন করে গঠন করা উচিত। এটা পুরোটা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটার সংস্কার শুধু নয়, এটার মূলোৎপাটন করা উচিত। শুধু তাই নয়, টিক মার্ক দিয়ে মেধার যাচাই করা যায় না। ভাষা জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

গত ১৬ বা ১৮ বছরে একটা দেশের সব প্রতিষ্ঠান একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ ও নির্বাচন চুরি করা হয়। যার ফলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। আরবের ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ যুগের মতো অবস্থা ছিল। হত্যা, গুম, খুন, ডাকাতি, চুরি, ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট এগুলো করে দেশকে সর্বস্বান্ত করে ফেলা হয়। এরা ছিল লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণি। পরিকল্পিতভাবে দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যায়। সম্পদ বিদেশে পাচার করায় দেশের মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়। ভারতের কথা যদি বলি আদানি, টাটা, ডাল মিয়া এরাও লাভ করে, এরাও শ্রমিকদের বঞ্চিত করে কিন্তু তারা তাদের পুঁজি দেশে বিনিয়োগ করে। হাসিনার লোকদের এদের কোনো জাতীয় চরিত্র নেই। এর ফলে মানুষ বাজারে গিয়ে হাঁসফাঁস করে। এই কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই কমাতে পারে নাই। এ জন্য মানুষ মুক্তির প্রতীক্ষা করেছে। এ কারণেই মানুষ ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয়, মুক্তি চায়। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই বলেছিল, আমিই রাষ্ট্র, আমি যা বলি তাই আইন। হাসিনার শাসনও আইন ছিল। হিটলার পতনের তিন বছরের আগে বলেছিল, আমরা (জার্মানরা) বিশ্বকে এক হাজার বছর শাসন করব। হাসিনা যখন বলে, হাসিনা পালায় না। এই কথা বলার তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গেল।

সমাজে বিশৃঙ্খলা দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই কাজ শুরু করেছে; কিন্তু পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শ, যে গণহত্যা হয়েছে যত ছাত্র আত্মাহুতি দিয়েছে স্বৈরাচার থেকে মুক্তির জন্য তাদের হত্যার বিচার করতে হবে। এটাকে প্রায়রিটি দিতে হবে। হাসিনাসহ সব হত্যাকারী ও লুটেরাদের বিচার করতে হবে। তৃতীয়ত, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কারণ ড. ইউনূস বিশ্বনন্দিত মানুষ। তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আছে। আমি আশাবাদী কারণ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। সব সম্ভব নয় কিন্তু একটা অংশ তো ফিরে আসবে।

সরকার তো আহত-নিহতদের সাহায্য করছে। আমরা যারা শিক্ষক তারা মিলে একটা ফান্ড সৃষ্টি করতে পারি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যদি আসে তাহলে আমরা এই ফান্ড গঠন করতে চাই। এই ফান্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সচিব বা ইউজিসি চেয়ারম্যান তাদের কাছে থাকবে। ছাত্ররা যদি চায় আমি দায়িত্ব নিয়ে একটা ফান্ড করতে চাই।

লেখক: সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত