চলচ্চিত্র নিয়ে সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে ‘চলচ্চিত্র-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ পুনর্গঠন করেছে সরকার। ২৩ সদস্যের কমিটির নাম প্রকাশ্যে আসার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল। কমিটিতে আমলাদের আধিক্য থাকায় চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। পাশাপাশি দশকের পর দশক ধরে পুঞ্জীভূত সংকট নিরসনে এই পরামর্শক কমিটি কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটাও আলোচনায় এসেছে।
রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে সরকার, পুনর্গঠন করেছে চলচ্চিত্র অনুদান কমিটিসহ বেশ কয়েকটি কমিটি। গুরুত্ব বিবেচনায় বাকি কমিটিগুলোর চেয়ে পরামর্শক কমিটিকে তুলনামূলক এগিয়ে রাখতে চাই আমরা। তবে পরামর্শক কমিটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৩ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশই আমলা। চলচ্চিত্র অঙ্গনের প্রতিনিধি হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমলার মধ্যে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা নীতিনির্ধারণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনদের মধ্যে যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই যোগ্য।
তবে অংশীজনের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার ছিল। কমিটিতে থাকা চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা যোগ্য ব্যক্তি। তবে আমলা-নির্ভর কমিটিতে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। চলচ্চিত্রের কাঠামোগত সংস্কারে পরামর্শক কমিটির জন্য করণীয় কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছেন; এর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম সার্টিফিকেশন ও ওটিটি নীতিমালা সংশোধন, ই-টিকেটিং, বক্স অফিস কার্যকর ও চলচ্চিত্রের বণ্টনে ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
দেশে সিনেমা ব্যবসার সবচেয়ে বড় সংকট, কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে সেই হিসাব পাওয়া যায় না। এ জন্য ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসের হিসাব সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা দরকার। সঙ্গে সিনেমার টিকিটের টাকার ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা দরকার। এ ছাড়া দেশজুড়ে মাল্টিপ্লেক্স করা; বুসান, সানড্যান্স, বার্লিন, রটারডাম, ফিল্মবাজার স্ক্রিন রাইটার্স ল্যাবের মতো ফিল্ম ফান্ড ও সাপোর্ট সিস্টেম করা এবং অনুদান প্রথার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্তিত অনুদানপ্রথা কেমন হবে, তা ঠিক করা দরকার। অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতাদের মধ্যে অর্ধেক নারী-নির্মাতা থাকতে হবে। অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতাদের স্ক্রিন ল্যাবের মতো ইনকিউবিটরে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মেন্টর দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
সাধারণত এফডিসি, সার্টিফিকেশন বোর্ড, আপিল বোর্ড ও ফিল্ম আর্কাইভের মতো চলচ্চিত্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকেন আমলারাই। ফলে চলচ্চিত্রের নীতিনির্ধারণে চলচ্চিত্রের অংশীজনেরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন না। শুধু সার্টিফিকেশন বোর্ড নয়, পরামর্শক কমিটি, আপিল কমিটি, অনুদান কমিটিসহ সবখানেই আমলারাই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা সভাপতি। এফডিসি বা বিসিটিআইয়ের মতো জায়গাগুলোতে যেখানে চলচ্চিত্র উন্নয়ন বা শিক্ষা নিয়ে কাজ-কারবার হওয়ার কথা, সেখানেও পদাধিকারবলে আমলারাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।
একটা স্বাধীন দেশে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? আমলাতন্ত্র দেখবে চলচ্চিত্রে জাতীয় স্বার্থ, চিন্তা-চেতনা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না। চলচ্চিত্রের উন্নতি নিয়ে আমলারা খুব একটা ভাবেন না। ফলে চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দ ভাবনার জায়গায় আমলারা নেই। কমিটির কাঠামোই এমন যে নতুন চিন্তা উৎসাহিত হবে না। চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না। কমিটিতে চলচ্চিত্রের অংশীজনের সংখ্যা কম থাকায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন না। ফলে এ ধরনের কমিটি খুব বেশি কার্যকর হয় না।
অন্তর্বর্তী সরকার থাকা অবস্থায় হয়তো আমলারা সহযোগিতাই করবেন, কিন্তু রাজনৈতিক সরকার আসার পরও যদি এসব ভয়াবহ আইন আর আমলাতন্ত্রই থেকে যায়, তাহলে আর সেটাকে সংস্কার বলা যাবে না। তার জন্য পরামর্শক কমিটিকে এখনই ভাবতে হবে। বুনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলো আর ক্ষমতা কাঠামোয়। সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের। একটা চলচ্চিত্র কাঠামো করা উচিত, যার অধীনে ফিল্ম গ্রান্ট অ্যান্ড সাপোর্ট, ফিল্ম কমিশন, সার্টিফিকেশন বোর্ড, ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড সব চলে আসবে।
এসব বোর্ডের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং তাদের কাজের নিয়মিত মূল্যায়নের দায়িত্ব থাকা উচিত পরামর্শক কমিটির। পরামর্শক কমিটিতে সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্যের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কোনো কিছু হুট করে পরিবর্তন করা যায় না। চলচ্চিত্র নীতিমালা অনুযায়ী পরামর্শক কমিটি হয়েছে। ফলে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নীতিমালাও পরিমার্জন ও সংশোধন করা দরকার। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে তো সেটা হবে না, তবে রাষ্ট্র কীভাবে তার ভূমিকা রাখবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বুনিয়াদি সংস্কারের জন্য প্রথমেই হাত দিতে হবে আইনগুলো আর ক্ষমতা কাঠামোয়।
সব প্রতিষ্ঠান বা কমিটি থেকে আমলাদের সরিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে সিনেমার অংশীজনদের। জাতীয় পরামর্শক কমিটির কার্য-পরিধির মধ্যে রয়েছে- চলচ্চিত্র নীতিমালার আলোকে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে পরামর্শ দেওয়া; নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া; চলচ্চিত্র নীতিমালা ও চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন, বিধি পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রযোজন হলে তা সুপারিশ করা। এখনো কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়নি। চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিশেষ করে ই-টিকেটিং ও বক্স অফিসে জোর দিতে হবে। এগুলো হলে চলচ্চিত্রে স্বচ্ছতা আসবে, চলচ্চিত্র নীতিমালায়ও বিষয়গুলো আছে।
চলচ্চিত্রের নীতিমালায় মত ও বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি ধারাগুলো সংশোধন করা উচিত। ‘চলচ্চিত্র-বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি’ বিগত সরকারেও ছিল। ২০১৯ সালে কমিটি পুনর্গঠনের খবর এসেছিল। বিগত সরকারের পরামর্শক কমিটি দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি। কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হলেও বিগত সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি। এখন প্রশ্ন, নতুন এই কমিটি কতটা কার্যকর হবে? আমরা অবশ্যই আশাবাদী। দেশে পরিবর্তন এসেছে; চলচ্চিত্রেও সবাই পরিবর্তন চাচ্ছেন। এবার হয়তো পরিবর্তনটা হয়ে যাবে। এটাই সংস্কারের সুযোগ, তবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে হবে এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও অংশীজনেরা তাদের সহযোগিতা করবেন।
চলচ্চিত্র-বিষয়ক যতগুলো কমিটি হয়েছে, তার মধ্যে পরামর্শক কমিটিই আমাদের বিবেচনায় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। এই পরামর্শক কমিটি থেকে পরামর্শ যা যাবে, তা যেন অংশীজনেরাই তৈরি করে দেন। সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল সম্পাদনের দিকটা দেখা উচিত। নীতি প্রণয়নে সরকারি কর্মকর্তাদের হাত না দেওয়াই ভালো হবে। কারণ তারা তো চলচ্চিত্র-বিষয়ক সমস্যা ও প্রয়োজনটা জানেন না। এখানে আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন, শিল্পকলা একাডেমির জমি আছে মোটামুটি দেশজুড়েই। কমপক্ষে ৩০ জেলায় শিল্পকলার জায়গায় মাল্টিপ্লেক্স করে সেটা দরপত্রের ভিত্তিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
যেহেতু আমাদের জাতিগত দুর্নাম ‘আমরা শুরু করি, অব্যাহত রাখি না’, সেহেতু এসব মাল্টিপ্লেক্সকে মনিটরিংয়ে রাখতে হবে এর মেইনটেন্যান্স মানে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, না হলে লিজ বাতিলের শর্ত থাকতে হবে। এখন ঝামেলা হলো শিল্পকলা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। আর সিনেমা-টিভি, ওটিটি তথ্য ও সম্প্রচারে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে হলেও এটা করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হচ্ছে সিনেমার জন্য তহবলিরে সংস্থান করা এবং তার পরিপূর্ণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা।
এখন ব্যস্ত জীবনযাপনে অনেকের নির্ভরযোগ্য বিনোদন অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। দর্শকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের কনটেন্ট এ বৈচিত্র্যের সমাহার, আকর্ষণীয় চমক আর নতুনত্বের সম্ভার ঘটাতে বেশ সচেষ্ট। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে দর্শক বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে প্রতিটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। এসব কারণে কনটেন্ট তৈরির কাজে নিয়োজিতদের মধ্যেও এক ধরনের গা ঝাড়া দেওয়া মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। ধ্বংসের দারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের অনেক নির্মাতা, কলাকুশলী, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী ওয়েব ফিল্ম, ওয়েব সিরিজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন পেশাগত মনোভাব নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি নির্মাতার তৈরি অসাধারণ বেশ কিছু কাজ প্রত্যক্ষ করেছি, যেখানে আমাদের মেধাবী অভিনয়শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয়, চমক লাগানো বিষয়বস্তু, আধুনিক কারিগরি মানের উপস্থিতি লক্ষ করেছি। এভাবে আমাদের বিনোদনশিল্পে নতুন সম্ভাবনার অনেক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। আমাদের চলচ্চিত্র একসময় স্বর্ণযুগ পার করেছে। সময়ের আবর্তনে সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অব্যাহত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনোযোগী এবং যত্নবান হতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জয়যাত্রা চলছে। বাংলাদেশ তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কোনোভাবেই।
অনেক সম্ভাবনার আধার বিনোদনের নতুন এই প্ল্যাটফর্মটিকে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে মেধা ও সৃজনশীলতার পাশাপাশি সুরুচির চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কনটেন্ট নির্মাণে স্বাধীনতা থাকা মানে যাচ্ছেতাই যেনতেন কিছু একটা বানিয়ে পরিবেশন করা নয়, এটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে কনটেন্ট নির্মাণে সম্পৃক্তদের। দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সমাজমনস্কতা, ইতিহাস, রাজনীতিদর্শন- কোনোটিকে অগ্রাহ্য কিংবা জলাঞ্জলি দিয়ে কনটেন্ট নির্মাণ নয়, বরং সমাজমনস্ক, সাহসী আধুনিক রুচি ও মননশীলতার প্রকাশ সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে নতুন চিন্তা-চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে হবে। সমাজে বিদ্যমান অসংগতি, অন্যায়, দুর্নীতি, অবক্ষয় ইত্যাদি বিভিন্ন কনটেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরে সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন এবং প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। স্রেফ বিনোদন নয়, ওটিটি হয়ে উঠুক সমাজের দর্পণ, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার আমরা মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা