বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক গবেষণা করে বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। এ গবেষণাটি ইতিমধ্যে দেশে নানা কারণে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বেগুনের এই গবেষণা ও কৃষি খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দৈনিক বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন জাকির হোসেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন অনিন্দ্য আরিফ
দৈনিক বাংলা: সম্প্রতি বেগুন নিয়ে আপনার নেতৃত্বে একটি গবেষণা হয়েছে, যা একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আপনারা এই গবেষণায় কেন উদ্যোগী হলেন?
জাকির হোসেন: বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছিল পুষ্টিগত খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর সেটি করার সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি চলে আসে। আমাদের দেশে বেগুন একটি জনপ্রিয় সবজি। সেই বিবেচনায় খাদ্য হিসেবে বেগুন খুবই জনপ্রিয়। তাই নিরাপদ খাদ্যের প্রেক্ষিতেই আমাদের বেগুনের ওপর গবেষণার আগ্রহ তৈরি হয়। আবার আমরা জানি যে বেগুনে বড় ধরনের পুষ্টিগুণ আছে। তাই আমরা এই সবজিতে পুষ্টিগুণ বজায় থাকছে কি না, সেটিও গবেষণা করে দেখতে চেয়েছি। এটি ছিল আমাদের গবেষণার আরেকটি উদ্দেশ্য। আমরা আরও গবেষণা করে দেখতে চেয়েছি যে এই সবজিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে কি না। থাকলে সেটি কী পরিমাণে আছে এবং তা মানবদেহের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা গবেষণা শুরু করেছিলাম।
আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য থেকে জানতে পেরেছিলাম, বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় ৬০ শতাংশ বেগুন উৎপাদিত হয় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায়। এই এলাকার বেগুন দেখতে ভালো হয় ও এর পুষ্টিমান ভালো মানের বলে প্রচলিত আছে। তাই আমরা ওই অঞ্চলের বেগুনের ওপর গবেষণার সিদ্ধান্ত নিই। প্রায় দুই বছর ধরে আমরা ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ১১টি কৃষিখামারে উৎপাদিত বেগুন সংগ্রহ করি। এরপর সেগুলো ওভেনে শুকিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এসব বেগুনে লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়ামসহ একাধিক ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব উপাদান যে পরিমাণে থাকার কথা তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া গেছে। তবে এর বাইরে বেগুনে পুষ্টি উপাদান হিসেবে কপার, জিংক, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বেগুন ও মাটির পরীক্ষা থেকে আমরা ধারণা করছি, ক্ষতিকর ধাতুগুলো খামারিদের ব্যবহার করা মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক কিংবা সেচের পানি থেকে এসেছে।
দৈনিক বাংলা: আপনারা কতজন এই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন এবং কোনো আন্তর্জাতিক জার্নালে এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে?
জাকির হোসেন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগ থেকে আমি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিই। গবেষক দলে আরও ছিলেন এমএস (থিসিস) শিক্ষার্থী আনিকা বুশরা, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির, ড. মো. শাহিনুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক সুপ্তি মল্লিক। এ ছাড়া কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশিদ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির ড. শায়লা শারমিনসহ মোট সাতজন এই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন। সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমরা এই সরেজমিন গবেষণা শুরু করি।
এ গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যা ‘ন্যাচার পোর্ট ফোলিও’র অন্তর্ভুক্ত একটি জার্নাল। আমাদের গবেষণার লক্ষ্য ছিল, এই বেগুন চাষের মাটিতে কতটা ভারী ধাতু রয়েছে। আর চাষ করা বেগুনে এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি মানবদেহে কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, গবেষণা করে সেটির ফলাফল পাওয়াও গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
দৈনিক বাংলা: এই গবেষণার ফলাফলটি কি শুধু জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার বেগুন চাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? সারা দেশের বেগুন চাষের ওপর কি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে?
জাকির হোসেন: এটি কিন্তু সারা দেশের বেগুন চাষের চিত্র নয়। এটিকে শুধু জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলায় চাষ করা বেগুনের ওপর চালানো একটি কেস-স্টাডি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তবে আমরা মনে করি, সারা দেশের বেগুন চাষের ওপর গবেষণা করা প্রয়োজন।
দৈনিক বাংলা: এর আগে তো বিটি বেগুন চাষ নিয়েও প্রবল আপত্তি উঠেছিল।
জাকির হোসেন: আমরা যে বেগুনের ওপর গবেষণা করেছি, সেটি কিন্ত বিটি বেগুন নয়। এটি এই এলাকার স্থানীয় জাতের একটি বেগুন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিটি বেগুনও আমাদের কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। আবার দেশীয় প্রজাতির এই বেগুনও একই ধরনের হুমকি তৈরি করছে।
দৈনিক বাংলা: আপনারা তো শুধু চাষ করা বেগুনের ওপর গবেষণা করে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। রান্না করার পর বেগুনে এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি কী পরিমাণ থাকবে?
জাকির হোসেন: আমরা রান্নার পর এই বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকবে কি না, সে বিষয়ে গবেষণা করিনি। কারণ আমরা জানি, বেগুন বা অন্য সবজিতে যে রাসায়নিক ধাতুর উপস্থিতি থাকে, রান্নার পর তার পরিমাণে খুব বেশি হেরফের হয় না। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছে। বেগুন বা অন্য সবজি কিংবা শস্যতে যে জৈব উপাদান থাকে, তার পরিমাণ রান্নার পর পরিবর্তন হয়। কিন্তু ভারী ধাতু থাকলে তা রান্নার পরও পরিমাণে প্রায় একই থাকে। হেভি টক্সিক মেটালের এই বেগুন ক্রমাগত গ্রহণ করলে মানবদেহে ক্যানসার হতে পারে।
দৈনিক বাংলা: কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কি বেগুন ছাড়াও অন্য সবজি ও শস্যের ওপর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে?
জাকির হোসেন: কৃষি খাদ্যের পুষ্টিমান নিশ্চিতের সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শুধু বেগুন নয়, অন্যান্য সবজির পুষ্টিমানের ওপর গবেষণা প্রয়োজন। সব ধরনের সবজি, সব ধরনের শস্যদানার ভেতর ভারী ধাতু কতটুকু আছে, সেটি গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধান করতে হবে। উদ্ভিজ্জ খাদ্যে বিষাক্ত উপাদানগুলোর প্রবেশকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যেসব সবজি ও শস্যে বেগুনের চেয়েও দ্রুত হারে বিপজ্জনক ধাতুর দূষণ ঘটে থাকে, সেগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা উচিত।
দৈনিক বাংলা: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন গবেষণার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে আপনারা বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করলেন। আপনারা কি আরও সবজি, শস্য বা প্রাণিজ খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছেন?
জাকির হোসেন: আমাদের এখনো বেশ কিছু সবজি ও শস্য নিয়ে গবেষণা চলমান আছে। আমরা আগে মাছের দুই-একটি প্রজাতি নিয়ে কাজ করেছি। দেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এমনিতেই অনেক কমে গিয়েছে। তার পরও নদী ও জলাশয়ে যেসব মাছের প্রজাতি আছে, প্রাকৃতিক পরিবর্তনে এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধাতু ও ক্ষতিকর উপাদান যুক্ত হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে গবেষণা চলছে। এই গবেষণাটি আমরা ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছি। এ ছাড়া সবজি, বয়লার মুরগি ও মোটা চালের ওপর একটি গবেষণা আমরা শেষ করেছি। এসবের মধ্যেও আমরা ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছি। এই গবেষণাটি স্প্রিনজার সায়েন্স অ্যান্ড বিজনেস মিডিয়ার ‘এক্সপোজার অ্যান্ড হেলথ’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
দৈনিক বাংলা: এর আগে প্রক্রিয়াজাত দুধে রাসায়নিকের উপস্থিতি পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এখন আপনারা গবেষণার মাধ্যমে চাষের বেগুনেও ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পেলেন। এই বিষয়গুলো খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করছে না? সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
জাকির হোসেন: আমি দুধে রাসায়নিক পাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা যে গবেষণা করেছি, তার মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পুষ্টিনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে এসব গবেষণার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দরকার পড়েছে পদক্ষেপ নেয়ার। বিষয়টি এমন নয় যে বেগুন চাষের মাটি থেকে ভারী ধাতুর পরিমাণ হ্রাস করা যাবে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভারী ধাতুর পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য হয়তো লম্বা সময় লাগবে, কিন্তু তাতে পরিমাণ কমানো যাবে। আর যদি সেটি না করি, তাহলে ধাতুর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাতে খাদ্যের পুষ্টিনিরাপত্তা তৈরি করা যাবে না। বরং সেটি গোটা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য আমাদের এই ধরনের গবেষণাকে উৎসাহিত করা দরকার এবং ভবিষ্যতে আরও গবেষণা তৈরি করা প্রয়োজন। এই ধরনের গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়াটা একমাত্র হুমকি নয়। আরও শত শত কারণ থেকে যায়। তবে ভারী ধাতুর উপস্থিতি হ্রাস করার পদ্ধতি গ্রহণ করাটা খুব কঠিন নয়। পদক্ষেপ আর উদ্যোগ নেয়ার মধ্য দিয়ে এটির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। তাই আমাদের প্রথমে দেখতে হবে শস্য ও সবজি উৎপাদনে ইনপুটগুলো কী কী। সেই ইনপুটগুলোতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে কি নেই, সেটি যাচাই করতে হবে। তারপর সেটিকে কমিয়ে আনতে হবে এবং শূন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একেবারে আমরা শূন্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব না, তবে সহনীয় মাত্রায় নিতে পারব। সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ নিতে হবে। এই ভারী ধাতুগুলো যেন খাদ্যশৃঙ্খলে না ঢুকতে পারে কিংবা ঢুকলেও সহনীয় মাত্রায় থাকে, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তার অর্থ হলো খাদ্যে যেন স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকে, সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও সবল জীবন উপহার দিতে পারব।
দৈনিক বাংলা: অনেকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য জৈব কৃষিতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন। আপনি এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
জাকির হোসেন: এখনই সমাধান হিসেবে আমরা জৈব কৃষির দিকে চলে যেতে পারব, সেটি আমি মনে করি না। আমরা যদি এখনই জৈব কৃষির দিকে চলে যাই, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এতে উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং খাদ্য ঘাটতি তৈরি হতে পারে। তবে ক্রমান্বয়ে আমরা যদি জৈব কৃষির দিকে এগোতে পারি, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু হুট করে জৈব কৃষিতে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না।
দৈনিক বাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
জাকির হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা