দেশের পুঁজিবাজার থেকে গত আট বছরে ১২ লাখ বিনিয়োগকারী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ২০১৬ সালে পুঁজিবাজারে মোট বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট ছিল ২৯ লাখ ২৯ হাজার ১৮৯টি, যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৫২টিতে। এর মানে, আট বছরে ১২ লাখ ৬৪ হাজার ২৩৭ জন বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়ে চলে গেছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ১০৪ জন। এক বছরে ৯০ হাজারেরও বেশি বিনিয়োগকারী তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছেন। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে তারা আস্থা হারিয়েছেন।
বিনিয়োগকারী তারেক মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীরা টাকা হারাচ্ছেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য আর্থিক লাভ। কিন্তু লাগাতার লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীরা এখন আর ভরসা পাচ্ছেন না।’
অনেক বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আকতার হোসেন নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘শেয়ারের দাম কমায় ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছেন না অনেকে। ফোর্স সেলের কারণে ভালো শেয়ারও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, ফলে বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।’
ব্রোকারেজ হাউসগুলোতেও কর্মচাঞ্চল্য কমে গেছে। গ্লোবাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের শাখা ব্যবস্থাপক আসাদ লিটন জানান, নতুন বিনিয়োগকারী আসছেন না, বরং অনেকেই লোকসান দিয়ে হলেও টাকা তুলে নিচ্ছেন। বাজার স্থিতিশীল না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) টাস্কফোর্স সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন না। অনেক অ্যাকাউন্ট বহুদিন ধরে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কমিশনের কঠোর পদক্ষেপ বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে বিএসইসি ১২টি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৭২০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে। হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আগের কমিশন কারসাজির ৯৮ শতাংশ বিচার করেনি। বর্তমান কমিশন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে।’
ডিএসইর লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত এক বছরে প্রধান সূচক ১ হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে এবং বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজার থেকে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে তথ্য উঠে এসেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, প্রতারণা, কারসাজিসহ প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, শেয়ারবাজারে প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে।
যারা ব্যাংক খাতের অপরাধী, তারা শেয়ারবাজারে আস্থা নষ্ট করার পেছনেও ছিল বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।
এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো কাজী ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম আরিফা সিদ্দিকী।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা