বিতর্কিত ওয়াকফ বিলের প্রস্তাব পেশ করার পর থেকেই ভারতজুড়ে শুরু হয়েছিল সমালোচনার ঝড়। তবে ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলটি এরই মধ্যে ভারতের সংসদে পাস হয়েছে। এখন এটিতে শুধু রাষ্ট্রপতির সইয়ের অপেক্ষা। এই সংশোধনী বিলটি পাসের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গজুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। গতকাল শুক্রবার কলকাতার পার্ক সার্কাসের সেভেন পয়েন্টে ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের নামে হাজার হাজার মানুষ।
পোস্টার, পতাকা, স্লোগান দিয়ে বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে তারা। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিতে শোনা যায়। এই সমাবেশের পর কার্যত সেভেন পয়েন্ট অবরুদ্ধ করেন বিক্ষোভকারীরা। এক পর্যায়ে তাদেরকে সামাল দিতে নামানো হয় পুলিশ বাহিনী।
কলকাতার পার্ক সার্কাসের পর আসানসোলেও এই বিতর্কিত বিলের বিরুদ্ধে পথে নামেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়। বিক্ষোভ সমাবেশে আসা মো. জামাল উদ্দিন শেখ বলেন, আমারা এই বিলের প্রতিবাদে আসানসোল বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দিলাম। আগামী দিনে যদি এই বিল না ফেরত নেওয়া হয় তাহলে কলকাতা থেকে আসানসোল পর্যন্ত অবরোধ করা হবে।
অপর আরও এক বিক্ষোভকারী আব্বাস আলী খান জানিয়েছেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছি। আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদেই আমরা সবাই একত্রিত হয়ে এই বিলের প্রতিবাদ করছি। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এখনো এই ওয়াকফ বিল ফেরত না নেয় তাহলে এর থেকেও বড় আন্দোলনে যাওয়া হবে।
ওয়াকফ বিল নিয়ে মুসলিমদের আপত্তির কারণ কী?
ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবল আপত্তির মধ্যেও লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাস হয়েছে বিতর্কিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫। বুধবার গভীর রাতে লোকসভায় এবং বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিলটি অনুমোদন পায়। ৭০ বছরের পুরোনো ওয়াকফ আইনে পরিবর্তন আনতে আনা এই বিল এখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের অপেক্ষায়, যা হলে এটি আইনে পরিণত হবে। বিরোধী দলের দাবি, নতুন সংশোধনীর ফলে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব হয়ে যাবে, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
নতুন এই সংশোধনী আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো ওয়াকফ সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং আয় বাড়ানো। সংসদীয় বিষয়ক এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু দাবি করেছেন, ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৮ লাখ ৭২ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যেগুলো থেকে রাজস্ব আহরণ করার কথা থাকলেও বাস্তবে আয় হচ্ছে খুব কম। ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা আয় হয়েছিল, যেখানে আয় হওয়া উচিত ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। নতুন আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়বে এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে বলে দাবি করেন রিজিজু।
তবে বিরোধী দলগুলো এবং মুসলিম সংগঠনগুলো এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে এবং অমুসলিমদের বোর্ডের সদস্য করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা বোর্ডের কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলবে। বিরোধীদের দাবি, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তির ওপর সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি কৌশল। নতুন আইনে সরকারি সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দাবি করার ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভূমিকা বাড়ানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় এই বিল নিয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টার তুমুল বিতর্ক চলে। বিরোধীরা বিলের বিরুদ্ধে সরব হলেও শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে বিলটি ১২৮-৯৫ ভোটে পাস হয়। ভোটের মাধ্যমে বিরোধীদের দাবি নাকচ করে সরকার বলছে, নতুন এই আইন মুসলিম সমাজের গরিব, নারী ও অনাথ শিশুদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবেগৌড়া এই বিলকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, এটি দরিদ্র মুসলিমদের রক্ষা করবে এবং সংবিধানের মৌলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে এবং এটি একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়াকফ ঘোষণার আগে তার সম্পত্তি থেকে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য অংশ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী ও অনাথদের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আয় যদি এক লাখ টাকার বেশি হয়, তবে সেটির নিরীক্ষা করাতে হবে এবং রাজ্যের নিরীক্ষকরা এটি তদারকি করবেন। এর পাশাপাশি, কোনো সরকারি জমিকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা হলে, তার তদন্ত করবেন জেলা কালেক্টরের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সংশোধনীর ফলে ওয়াকফ বোর্ড আরও কার্যকর হবে এবং সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে। তবে বিরোধীদের আশঙ্কা, নতুন আইন মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার খর্ব করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে ওয়াকফ বোর্ডের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ভারতে মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর পড়বে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা