আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০২২ ১৫:২৬
মিডলাইফ ক্রাইসিস

মিডলাইফ ক্রাইসিস

মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে কিছু আছে সেটি অনেকেই স্বীকার করতে না চাইলেও এটি একটি মানসিক অবস্থা, কখনো কখনো তা গুরুতরও হতে পারে

মানুষ তার জীবনে চলার পথে মাঝ বয়সে এসে এক ধরনের সংকট মোকাবিলা করেন। এটি প্রথম শনাক্ত করেন বিখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদ এলিয়ট জ্যাক। তিনি তার গবেষণা এবং লেখায় ১৯৬৫ সালে ‘মিডলাইফ ক্রাইসিসের’ কথা প্রথম উল্লেখ করেন।

ফোর্বস হেলথের মতে, ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’কে মধ্যবয়সে মানসিক আন্দোলনের বা অশান্তির সময় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যা প্রায় ৪0 থেকে ৬০ বছর বয়সীদের পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষার বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ করে।

এই সংকটটি আত্মধারণা এবং আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে এই মাঝ বয়সের রূপান্তর মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ, আচরণ, আবেগ এবং সম্পর্কের পরিবর্তনও ঘটে।

মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে কিছু আছে সেটি অনেকেই স্বীকার করতে না চাইলেও এটি একটি মানসিক অবস্থা, কখনো কখনো তা গুরুতরও হতে পারে। আবার কেউ কেউ যে এই মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তা নিজেরাই বুঝতে পারেন না।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডলাইফের ওপর করা একটি জাতীয় সমীক্ষায় কতজন লোক মিডলাইফ ক্রাইসিস অনুভব করেন তা নির্ধারণ করার জন্য পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, আনুমানিক ২৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মিডলাইফ ক্রাইসিসের কথা জানিয়েছেন। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সার্বিক আচরণে একটি স্পষ্ট এবং আকস্মিক পরিবর্তনের প্রমাণই মানসিক সংকট।

আচরণগত পরিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়

*ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা

* ঘুমের অভ্যাসের পরিবর্তন

* ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি

* মেজাজে ঘন ঘন পরিবর্তন। যেমন: রাগ, বিরক্তি, দুঃখ বা উদ্বেগ।

*স্বাভাবিক রুটিন বা স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে প্রত্যাহার।

সুখের মন্দাভাব

অর্ধমিলিয়ন আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানদের তথ্য অনুযায়ী পরিচালিত গবেষণায় সুখকে ইউ আকৃতির কার্ভ বলে বিবেচনা করা হয়। সুখের ক্রমশ হ্রাস বা মন্দাভাব কিশোর বয়সের শেষের দিকে শুরু হয় এবং ব্যক্তির ৪০ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। বয়স ৫০-এর দিকে এলে সুখ আবার বাড়তে শুরু করে।

তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখ হ্রাস পেতে থাকে। সুতরাং ৪০-এর কাছাকাছি বয়সে এসে কেউ কেউ মনে করেন, জীবন দিনে দিনে কেবল আরও খারাপ হতে চলেছে, যা মিডলাইফ ক্রাইসিস সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

এ ছাড়া মিডলাইফ ক্রাইসিসের কিছু কারণ চিহ্নিত করা যায়-

* ক্যারিয়ার নিয়ে অসন্তুষ্টি

* অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব

* বার্ধক্যের ভয়

* জীবনে যা করার ইচ্ছে ছিল তা করতে না পারার ব্যর্থতাবোধ,

* সঙ্গীর সঙ্গে যৌনজীবনের বিচ্ছেদ বা অবসান ইত্যাদি।

মোটাদাগে বলা যায়, জীবনে অবসাদ লাগে, কাজে স্পৃহা কমে যায়, খিটখিটে স্বভাবের কারণে খারাপ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ সময় অনেকে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেন, নিজের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, শরীরের বাড়তি ওজন- বাজে দেখাচ্ছে এমন মনোভাব, চাকরিজীবনের উপার্জন স্থির নয়, ভবিষ্যতের যথেষ্ট সঞ্চয় নেই, সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত নয়- ইত্যাদি সমস্যায় অনেকে এটিকে অস্বীকার করে তারুণ্যের হারানো দিনগুলো ফিরে পেতে চান।

সমাধান

* থাকতে পারে কাজের অতিরিক্ত চাপ, ঝামেলা হতেই পারে আর্থিক সংগতি রাখতে বা সঙ্গীর সঙ্গে মনোমালিন্য। সন্তান এবং বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে রাখতে নিজের ওপর অতিরিক্ত চাপ পরার বিষয়টি আমলে নেন না অনেকেই। তাই জরুরি নিজের জন্য একটু থামার জন্য সময় বের করা।

* মিডলাইফ জীবনে পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনগুলো নোট রেখে এ সম্পর্কে সচেতন এবং কার্যকরী মনোভাব রাখা। জীবনের যেকোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

* বন্ধু এবং আত্মীয়দের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়া।

* মিডলাইফ ক্রাইসিস বৈবাহিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। প্রেমময় জীবনকে সুন্দর করতে সঙ্গীর সঙ্গে ঘুরতে, সময় কাটাতে বা ডিনারে যাবার জন্য সময় বের করা।

* স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা।

* নিজের প্রগাঢ় ইচ্ছার কোনো প্রজেক্টে সময় কাটানো।

*প্রয়োজনে ডাক্তার কিংবা থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হওয়া।

মিডলাইফ ক্রাইসিসের ইতিবাচক দিকও আছে!

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ বিহেভিওরাল ডেভেলপমেন্টে প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণায়- মিডলাইফ ক্রাইসিসের সঙ্গে কৌতূহলের ঊর্ধ্বগতির সম্পর্ক পাওয়া যায়। গবেষকরা দেখেছেন, মানুষ যারা এই সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন, তারা নিজেদের এবং তাদের চারপাশের বিস্তৃত বিশ্ব সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি কৌতূহল অনুভব করেন।

কিন্তু মিডলাইফ ক্রাইসিস নামের যে মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বহু পুরুষ ও অনেক ক্ষেত্রে নারীদেরও তা নিয়ে আলোচনার ঘাটতি রয়েছে। বয়স চল্লিশ পার হলে অনেকে নিজ উদ্যোগেই বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা করান, কিন্তু মানসিক অবস্থা কেউ নিজ বা পরিবার থেকে নিতান্ত অসুস্থ না হলে যাচাই করেন না। এই বিষয়ে পরিবারের সতর্ক পর্যবেক্ষণ, জ্ঞান এবং নিজের আরাধ্য জীবনকে নানানরূপে আলিঙ্গনের ইতিবাচক মনোভাব বন্ধুর পথকেও করতে পারে সহজ এবং সহনশীল।