নৃত্যকলা নৃত্যকলা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শিল্পমাধ্যম। শরীর, ছন্দ, আত্মা, মন, সংগীত- এসব নিয়ে নান্দনিক ছন্দিত শরীরী প্রতিমাই হলো নৃত্য। কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী মার্থা গ্রাহাম বলেছেন, নৃত্য হলো লুকিয়ে থাকা আত্মার ভাষা। পণ্ডিত বিরজু মহারাজ বলেছেন, নৃত্য হলো প্রকৃতি। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শুনলেই বোঝা যায়, সে তার নিজস্ব ছন্দে নাচছে। শাস্ত্রীয় নৃত্য ও সংগীত মিলে মন ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে। নৃত্য খুব সহজেই সবার কাছে পৌঁছায় ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। নৃত্যের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়, মানুষে মানুষে বিনিময় ঘটে, কথা হয়। নৃত্য এমনই একটা মাধ্যম, যা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একটা আকৃতি দেয়, যা প্রত্যেকের ব্যক্তিক-অভিব্যক্তির জন্যও প্রয়োজনীয়। দুঃসময়ে-দুর্দিনে নৃত্য ও অন্যান্য উপস্থাপন-কলা মানুষের মধ্যে আনন্দ বিতরণ করে, যা আমাদের সত্তার ও সময়ের পরিচয় ঘটায়।
আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। এ দিবসটি কেন্দ্র করে প্রতি বছরই নৃত্য শিল্পীদের নূপুরের ঝংকারে আন্দোলিত হয়ে আসছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো। তবে গত কয়েক ধরে করোনার ছোবল এবং রোজার কারণে নাচ বা নৃত্য নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। তবে খুব বেশি জমকালো না হলেও এবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে নৃত্য দিবস।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের আয়োজনে আজ মঙ্গলবার এবং আগামীকাল বুধবার জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হবে ২ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ‘মুক্ত সুরের ছন্দ’। আজ বিকেল ৫ টায় জাতীয় নাট্যশালার সম্মুখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। একাডেমির সচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেন-এর সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক মেহজাবীন রহমান। এছাড়াও বিশিষ্ট নৃত্য পরিচালক ও নৃত্যশিল্পীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। অতিথিবৃন্দের বক্তব্যের পর নাট্যশালার সম্মুখে বেলুন উড়িয়ে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা। এরপর থাকবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে দুই দিনব্যাপী মূল আয়োজনে বিভিন্ন পরিবেশনায় থাকবেন- ভঙ্গিমা ড্যান্স থিয়েটার, তপস্যা, অ্যালিফিয়া ডান্স এটেলিয়ার, ভাবনা নৃত্যদল, রেওয়াজ পারফর্মাস স্কুল, কাথ্যাকিয়া-দা সেন্টার অফ আর্টস, নৃত্যসুর, নাইম খান ডান্স কোম্পানী, দীক্ষা, বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস, বাংলাদেশ গৌড়ীয় নৃত্য একাডেমি, নান্দনিক নৃত্য সংগঠন, আটিস্ট্রি, নৃত্যালোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কালারস অব হিল, বন্যা ললিতকলা একাডেমি, দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন, নন্দন কলাকেন্দ্র, নৃত্যভূমি, ঘুঙ্গুর নৃত্যালাপ এবং শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীবৃন্দ।
দেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলেও রাখা হয়েছে নাচ নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান। এরমধ্যে আজ রাত সাড়ে ১০ টায় মাছরাঙা টেলিভিশনে প্রচার হবে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মায়া বেঙ্গল ইন মোশন’। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানের একটি কনভেশন সেন্টারে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি ধারণ করে মাছরাঙা টেলিভিশন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্মের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচের মেলবন্ধন ও শিল্পের সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে বরেণ্য ও নবীন শিল্পীদের পরিবেশনায় উপস্থাপিত হয় চারটি শাস্ত্রীয় নৃত্যরূপ ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরি ও ওডিশি। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় আনিসুল ইসলাম হিরু ও মাহবুবা মাহনূর চাঁদনীর পরিবেশনার মাধ্যমে। এরপর পর্যায়ক্রমে নৃত্য পরিবেশন করেন সাদিয়া ইসলাম মৌ, সাবরিনা শফি নিশা, বেনজীর সালামের দল, সামিনা হোসেন প্রেমা, আনিকা কবির শখ, তামান্না রহমান ও তাদের দল।
এছাড়া আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান ‘নৃত্যসুধা’। অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি নানা রকম নৃত্য পরিবেশন করেন খ্যাতিমান ও উদীয়মান শিল্পীরা। অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় ছিলেন নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমান। নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নেন বেলায়েত হোসেন খান ও তার দল, মুনমুন আহমেদ ও তার দল, কবিরুল ইসলাম রতন ও তার দল, প্রমা অবন্তী ও তার দল, তামান্না রহমান ও তার দল এবং ইয়্যাং হুই ও তার দল। নৃত্যসুধা’র ৫ম পর্বের এই অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয় নৃত্যের নানা ধারা- মনিপুরী, ওড়িশী, ভরতনাট্যম ও কথক নৃত্যের পরিবেশন করা হয়। পাশাপাশি বিদেশি যন্ত্রসংগীতে দেশীয় নৃত্যের বিশেষ কম্পোজিশন পরিবেশন করেন শিল্পীরা। দর্শকরা আরও দেখতে পান কোরিয়ার পাখা নৃত্য, জার্মানির লোকনৃত্য, জাপানিজ নৃত্য, হাওয়াইয়ের হুলা নৃত্য ও নেপালের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। অনুষ্ঠানে ছিল ইয়্যাং হুই-এর পরিচালনায় চীনা ঐতিহ্যবাহী ও সমকালীন নৃত্য পরিবেশনা। এছাড়া আজ রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন জেলা শহর এবং শিল্পকলা একাডেমিতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ১৯৮০ সালে তার জন্মদিন ২৯ এপ্রিলকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস ঘোষণা করে। তখন থেকে পৃথিবীব্যাপী এ দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়ে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিল বাংলাদেশ শাখা ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা যৌথভাবে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠান পালন করে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা