আপডেট : ১৩ নভেম্বর, ২০২২ ২৩:০৮
আ.লীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লবের লাশ উদ্ধার: দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড?
বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক বাংলা ও প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ

আ.লীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লবের লাশ উদ্ধার: দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড?

আওয়ামী লীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লব। ছবি: সংগৃহীত

টানা পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লব। কেরানীগঞ্জের খামার থেকে মোহাম্মদপুরের বাসায় ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু বাসায় ফেরেননি। পাঁচ দিন পর গত শনিবার বিকেলে তার লাশ পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গা নদীতে। স্বজন ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি নৌ-দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এখনো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অবশ্য ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, তাকে হত্যা করা হতে পারে। তার মাথায় ও বুকে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, দুরন্ত বিপ্লবের নিখোঁজের বিষয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করা হয়েছিল। তারা দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি নৌ-দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে।

দুরন্ত বিপ্লব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন।

এর আগে গত ৪ নভেম্বর রামপুরা থেকে নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারদিন নূর পরশ নামে এক শিক্ষার্থীর লাশ তিন দিন পর উদ্ধার করা হয় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। লাশ উদ্ধারের প্রায় সাত দিন পেরিয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নৌ-পুলিশের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ৩১৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৬২টি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। হত্যা মামলা হয়েছে ৪১টি। এখনো ৯২টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। আর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে সারা দেশের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে ৩৫৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১২৩টি ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা ও ৩৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। ৮৮টি লাশের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ৭ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ থেকে কামরাঙ্গীরচরে আসার পথে সোয়ারীঘাট এলাকায় একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের ধাক্কায় একটি নৌকা থেকে একজন যাত্রী পড়ে যাওয়ার তথ্য পেয়েছেন। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লব ওই ব্যক্তিই কি না তা যাচাই করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া নৌকার মাঝিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। দুরন্ত বিপ্লবের মোবাইলের কল ডিটেইলস রেকর্ড পর্যালোচনা করেও সর্বশেষ কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ এলাকায় পাওয়া গেছে।

স্বজনরা জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে অর্গানিক খাদ্যপণ্য ও কৃষি খামার নিয়ে কাজ শুরু করেন দুরন্ত বিপ্লব। সর্বশেষ তিনি কেরানীগঞ্জে রতনের খামারে একটি মাছ ও কৃষির সমন্বিত খামার গড়ে তুলেছিলেন। থাকতেনও কেরানীগঞ্জ এলাকার খোলামোড়া এলাকায়। গত ৭ নভেম্বর তিনি খোলামোড়ার বাসা থেকে রতনের খামারে যান। সেখান থেকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি মোহাম্মদপুরের হাউজিং সোসাইটির বাসায় ফেরার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু রাত হলেও তিনি বাসায় না আসায় এবং মোবাইল বন্ধ পেয়ে স্বজনরা খোঁজ শুরু করেন। একদিন পর গত ৯ নভেম্বর তার বোন শাশ্বতী বিপ্লব কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

নৌ-পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, গত শনিবার বিকেলে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় একটি অজ্ঞাত লাশ ভাসতে দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। পরে নৌ-পুলিশের সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

ফতুল্লার পাগলা নৌ-ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক শাহ্জাহান আলী জানান, মরদেহটি পঁচে গিয়েছিল। চেহেরা ফুলে বিকৃত হয়ে গেছে। তবে মাথায় লালচে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পরে নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা মধ্যরাতে তার পরিচয় শনাক্ত করে।

নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মফিজ উদ্দিন প্রধান জানান, ‘নিহতের মাথায় ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাথার পেছনের দিকে বেশি আঘাত। বুকের দুপাশে আঘাতের দাগ আছে। ভারী কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়ে থাকতে পারে।’

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত দুরন্ত বিপ্লবের পকেট থেকে ৩৫০ টাকা পাওয়া গেছে। কিন্তু তার মোবাইল ও মানিব্যাগটি পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নৌ-দুর্ঘটনার শিকার না হলে ছিনতাইকারীদের হাতে তার মৃত্যু হতে পারে। কামরাঙ্গীরচর সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার এপার-ওপার অপরাধপ্রবণ এলাকা। সন্ধ্যার পর ছিনতাইকারীরা তার সবকিছু কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বিপ্লব বাধা দেয়ায় তাকে ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

দুরন্ত বিপ্লবের বোনের স্বামী ইমরুল খান বলেন, ‘দুরন্ত বিপ্লব ভাই একজন হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। আমরা ধারণাও করতে পারছি না তাকে কেউ হত্যা করতে পারে। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা করতে চাই। আমরা চাই এই ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হোক।’

স্বজনরা জানান, ময়নাতদন্ত শেষে দুরন্ত বিপ্লবের মরদেহ মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি এলাকার মসজিদে আনা হয়। পরে সেখানে জানাজা শেষে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলায়।